সেদিন বাতিঘরের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে ছিলাম। একটু দেরিতে যাওয়ায় অনেকের বক্তব্য শোনা হয়নি। আমি যাওয়ার পর বেশ কয়েকজন বক্তব্য রেখেছেন। এদের মাঝেই মোমেন মামার (আবুল মোমেন) বক্তব্য আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে। তিনি বরাবরই সুলেখক এবং সুবক্তা। যে কোনো বিষয় উনার বাণী আর লেখায় পাই অন্যরকম এক পূর্ণতা। বাতিঘর যেহেতু বইয়ের আড়ত, বইয়ের পাঠশালা, তাই বক্তব্যের মূল বিষয়ও বই সংক্রান্ত এবং এই বইঘরের রূপকার দীপংকরকে ঘিরেই ছিল আবর্তিত।
মোমেন মামা তাঁর বক্তব্যে কিছু অন্যরকম বইয়ের গল্প শোনান, যেগুলো উপস্থিত অনেকেরই অজানা। বইগুলো সম্পর্কে বলতে বলতে এক পর্যায়ে বই, গল্প বলা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এল। আজকাল বইয়ের পাঠাভ্যাস এবং গল্প শোনানোর বিষয়টি যেন পরিবার তথা সমাজ থেকে উঠে গেছে। এ যুগের মা’দের সময় নেই শিশুকে গল্প শোনানোর। আর নানি–দাদিরাও এখন বন্দি প্রযুক্তির করাল থাবায়! তাহলে এ যুগের শিশুদের কে শোনাবে ঘুম পাড়ানি গান ‘ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি মোদের বাড়ি এসো’ কিংবা ‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে’, অথবা ‘আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা’ ইত্যাদি ছড়া। ঘুম পাড়ানোর সময়ে কিংবা ভর দুপুরে ভাতঘুমে রূপকথার কল্প কাহিনি কে বলবে আজকের শিশু কিশোরদের? কে তাদের কোমল হৃদয়ে কল্পনা আর মায়ার জাল বুনে দেবে? এই প্রশ্ন এখন অনিবার্য হয়ে উঠেছে।
প্রথমত, শিশু মায়ের কোলে এই মায়াবী জগৎটি পাচ্ছে না। সে কিছু রাইম, কিছু কার্টুন, মোটু পাতলু এসব দেখেই বেড়ে উঠছে। দ্বিতীয়ত, তাকে গল্প শুনিয়ে তার কোমল মনে স্বপ্নের জগৎ তৈরি করার কেউ নেই! তদুপরি ৩/৪ বছর বয়সে যখন তাকে স্কুলে ভর্তি করাবে, ভোরে ঘুমচোখে তাকে নিয়ে দৌড়াবে স্কুল মুখে। স্কুলের ব্যাগভর্তি বই–খাতার চাপ নিতে নিতে এই শিশুর মনোজগতে কি মায়ার জগৎ তৈরি হবে, সেই শিশু কীভাবে স্বপ্নবান হবে তা সহজেই অনুমেয়।
আমরা শিশুকালে নানির মুখে কত কিসসা (রূপকথার গল্প) শুনেছি! আমার নানির রাজকীয় এক পালংক ছিল। আমরা নাতি–নাতনীরা সেই পালংকে গোল করে বসতাম। আমার নানি কি সুন্দর করে একের পর এক মজার মজার কিসসা শোনাতেন। জিন–পরির গল্প, দৈত্য দানবের গল্প, রাক্ষস আর খোক্ষসের গল্প, ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমীর গল্প। আবার টোনাটুনির গল্প, সাইন্যা পিঠার গল্প শোনাতেন। রাজকন্যাকে রাজা বনবাসে পাঠিয়েছে, কি কষ্ট তার! কিন্তু অচিনপুরের এক রাজপুত্র ঢাল তলোয়ার নিয়ে ঘোড়ায় চেপে এসে তাকে রাজরানি করে নিয়ে যায়।
এসব কল্পকাহিনী শুনে আমাদের কল্পনার জগৎ এত বেশি আলোড়িত হতো যে, নিজেরা ভাবতাম, ইস! কখন এ রকম এক রাজপুত্র এসে আমাকে নিয়ে উড়াল দেবে অচিনপুরের রাজ্যে। এসব স্মৃতিকথার অবতারণা করলাম বর্তমান প্রজন্মের নানি–দাদি আর মা’দের জন্য। তারা যেন শিশুর মনোজগতে স্বপ্নের জাল বোনেন। শিশুকে গল্প বলার ফাঁকে ফাঁকে বই পড়তে আগ্রহী করে তোলেন।
আমরা নতুন ক্লাসে উত্তীর্ণ হয়ে নতুন বইয়ের ঘ্রাণের জন্য উন্মুখ থাকতাম। বই হাতে পেয়ে প্রথমেই সমস্ত ছড়া, কবিতা মুখস্থ করে ফেলতাম আর সব গল্প পড়ে ফেলতাম। অবশ্য সবাই সেটি করত কিনা আমি জানি না। আমার আরো অনেক ঘটনা মনে পড়ছে। আমি খুব ছোটবেলায় মায়ের ট্রাংকভর্তি গল্প আর উপন্যাসের বই দেখেছি। তিনি বই পড়তেন, আমার শিক্ষাবিদ বাবা এসব বই কিনে দিতেন মাকে। সেখানে রান্নার বইও ছিল। বইটির নাম ছিল পাক প্রণালী। আরেকটি বইয়ের নাম মনে আছে, কার লেখা জানি না, বইয়ের নাম ছিল ‘পরিবার নহে কারাগার’। আমার মায়ের বয়স কম ছিল, হয়তো সে কারণেই বাবা এই বইটি কিনেছিলেন।
আমি একেবারে শিশু বয়সেই ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র সাথে সাথে ‘গালিভার্স ট্রাভেলস’, ‘হেলেন অব ট্রয়’ এই বইগুলো পড়ে ফেলেছিলাম। আমার মা ‘বেগম’, ‘ললনা’ এসব ম্যাগাজিনের নিয়মিত পাঠক ছিলেন। আর শিশু পত্রিকা ‘টাপুর টুপুর’ আমাদের বাসায় নেওয়া হতো। তাই বলে সুপ্রিয় পাঠক এমনটি ভাববেন না, আমি নিজেকে জাহির করছি। শুধুমাত্র এই প্রজন্মের শিশুদেরকে গল্প শুনিয়ে স্বপ্নবান করা এবং বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার বিনীত আহ্বানই এই লেখার অন্যতম উদ্দেশ্য।
আমার ইচ্ছে করে, প্রতি স্কুলে গিয়ে শিশুদের গল্প শুনিয়ে আসি। স্কুলের পাঠাগারে বসে যে কোনো একজন লেখকের লেখা ও জীবন নিয়ে শিশুদের সাথে আলোচনায় বসি। তাহলে শিশুরাও একাডেমিক বিষয়ের বাইরের বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে অনেক মনোযোগী হবে। আমরা হয়তোবা নতুন এই প্রজন্মকে কিছুটা স্বপ্নবান এবং বইমুখী করতে সক্ষম হব।