শিল্প পণ্য মেলার নামে কোটি কোটি টাকার লটারি বাণিজ্য চলছে। সর্বস্বান্ত হচ্ছে বন্দর পতেঙ্গা এলাকার হাজার হাজার মানুষ। মোটরসাইকেল ও স্বর্ণালংকারের লোভনীয় অফার দিয়ে প্রতিদিন গড়ে এক লাখ টিকেট বিক্রি করা হচ্ছে। করোনা মহামারীর এই সময়ে মেলার নামে লটারি বাণিজ্যের আসর নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রতিবন্ধীদের নাম ব্যবহার করে একটি সংঘবদ্ধ চক্র বাণিজ্য করছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। পুলিশ বলছে, মেলার জন্য অনুমোদন নেয়া হয়েছে। এখন করোনাকালে সরকারি নির্দেশনা এলে মেলা বন্ধ করে দেয়া হবে। সরেজমিনে অনুসন্ধান এবং স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পতেঙ্গা এলাকার এলিট হল মাঠে ১ জানুয়ারি থেকে শিল্প পণ্য মেলা নামের বিশেষ এক মেলার আয়োজন করা হয়েছে। চার ব্যক্তির একটি গ্রুপ বাংলাদেশ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী কল্যাণ সোসাইটি নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে মেলার আয়োজন করে। মেলার গেটের টিকেটের উপর প্রতিদিন ড্র অনুষ্ঠিত হয়। গেটের টিকেট বিক্রি করা হয় নগরীর বিস্তৃত এলাকা জুড়ে। মাইকিং করে টেক্সি ও রিকশার পাশাপাশি বুথ স্থাপন করে বিক্রি করা হয় মেলার প্রবেশ টিকেট। এই টিকেটের উপর প্রতি রাতে অনুষ্ঠিত হয় ড্র। যাতে মোটরসাইকেল ও স্বর্ণালংকার পুরস্কারের ঘোষণা দেয়া হয়। তবে অভিযোগ রয়েছে, এই পুরস্কার প্রদান নিয়ে প্রতারণা চলছে। ৩০ ডিসেম্বর শিল্প পণ্য মেলা উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। এতে ভিআইপি টিকেট বিক্রি করা হয়েছিল দুইশ টাকা এবং রয়েল টিকেট বিক্রি হয়েছিল ১৫০ টাকা করে। ওইদিন রাত ১০টা থেকে এই অনুষ্ঠানের সূচনা হয়েছিল। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নামে নানা অপকর্মেরও অভিযোগ করা হয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের পক্ষ থেকে। শিল্প পণ্য মেলায় প্রতিদিন প্রথম পুরস্কার হিসেবে একটি ১২৫ সিসি মোটরসাইকেল, শেষ পুরস্কার ১০০ সিসি চিতা মোটরসাইকেল, রানার ৮০ সিসি মোটরসাইকেল, ৫ আনা ২২ ক্যারেট স্বর্ণের চেইন, মোবাইল ফোন, ওয়াটার ফিল্টার, আয়রন শিট, রাইচ কুকার, স্যুপ সেট, প্রেশার কুকার, জুস বিল্ডার প্রভৃতি পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা দেয়া হয়। প্রতিদিন ছয়টি গ্রুপ করে টিকেট বিক্রি করার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কর্ণফুলী ইপিজেড থেকে নেভাল একাডেমি, মেলার মাঠ থেকে সী বিচ, মেলার মাঠ থেকে বন্দরটিলা (পশ্চিম পাশ), কর্ণফুলী ইপিজেড থেকে বন্দরটিলা, সল্টগোলা, সল্টগোলা ক্রসিং থেকে আনন্দবাজার রোড এবং বন্দরটিলা থেকে কলসী দিঘির পাড় পর্যন্ত রুট নির্ধারণ করে টিকেট বিক্রি করা হয়। প্রতিদিন ১৮০টি রিকশা ও ২০টি টেবিলে টিকেট বিক্রি করা হয়। এই কাজে আয়োজকদের অন্তত দুইশজন প্রতিনিধি নিয়োজিত রয়েছে। প্রতিজন প্রতিনিধিকে ৫শ টিকেট বিক্রি করতে দেয়া হয়। প্রতিটি ২০ টাকা করে বিক্রি হয় লটারির টিকেট। দুইশজন প্রতিনিধি প্রতিদিন গড়ে এক লাখ টিকেট বিক্রি করে। টিকেট বিক্রি থেকে আয় হয় বিশ লাখ টাকা। বাকি নেই। নগদ বিশ লাখ টাকা প্রতিদিন জমা হয় আয়োজকদের ফান্ডে। প্রতিনিধিদের নির্দিষ্ট হারে কমিশন প্রদান করা হয়।
গতকাল একজন টিকেট বিক্রেতা প্রতিনিধি বলেছেন, টিকেটের দাম বিশ টাকা। একেকজন মানুষ দশ-বিশটি পর্যন্ত টিকেট কিনে। যত বেশি টিকেট তত বেশি সম্ভাবনা।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, ইপিজেডের সাধারণ শ্রমিক, রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণী টিকেট কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। মেলা ও লটারির নামে জুয়ার আমেজ বিরাজ করছে বন্দর পতেঙ্গার বিস্তৃত এলাকাজুড়ে।
প্রতিদিন রাত ১০টায় লটারি হয়। মেলার অন্যতম আয়োজক মোহাম্মদ শামীম লটারি পরিচালনা করেন। ‘উঠাও বাচ্চা’ স্লোগান দিয়ে তিনি লটারি শুরু করেন। এ সময় কিছু লোক পুরস্কার পেলেও হাজার হাজার মানুষ ফিরেন শূন্য হাতে। অবশ্য লটারির জন্য মেলায় উপস্থিত হতে হয় না। গেটের টিকেটের উপর লটারি হলেও হাজার হাজার মানুষ টিকেট কিনে মেলায় যান না। বিডিপিকেএস নামের এক টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে প্রতি রাতের লটারি ইউটিউবে সরাসরি দেখানো হয়।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলেছে, ক্রিকেট আয়োজনের জুয়ার মতো প্রতি রাতে এই চ্যানেল খুলে বসে থাকে হাজার হাজার টিকেট ক্রেতা। শিল্প পণ্য মেলায় পণ্য বিক্রি কম হলেও প্রতিদিনকার লটারির টিকেট বিক্রি জমজমাট আকার ধারণ করেছে। লটারির টিকেট কিনে হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছে।
মোহাম্মদ শামীম, মোহাম্মদ বেলাল, মোশাররফ হোসেন ও বাদল নামের চার ব্যক্তি মেলার মূল উদ্যোক্তা। প্রতিবন্ধীদের কল্যাণের নামে পুলিশের কাছ থেকে অনুমোদন নেয়া হয়েছে। অবশ্য মেলার টিকেট বিক্রির ফান্ডের একটি বড় অংশ প্রতিদিন ভাগবাঁটোয়ারা হয় বলে জানা গেছে।
মেলার অন্যতম উদ্যোক্তা মোহাম্মদ শামীম বলেন, এটি একটি মেলা। প্রবেশ টিকেট বিক্রি করি। এটার ওপর লটারি হয়। তবে আমরা লটারির কোনো টিকেট বিক্রি করি না। স্থানীয়দের জুয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি জুয়া নয়। সারা দেশের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী লাখো মানুষের জন্য আমরা ফান্ড কালেকশন করছি। এতে আমাদের ব্যক্তিগত কোনো লাভ নেই। আমরা দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য শ্রম দিচ্ছি। তবে তিনি বলেন, ডিশ লাইন পুরোপুরি কাভারেজ দেয়া সম্ভব হয়নি। তাই মেলা জমেনি।
মেলার ব্যাপারে পতেঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ কবির হোসেন বলেন, মেলার অনুমোদন আছে। তবে কোনো অনিয়ম বা অসামাজিক কিছু হলে অবশ্যই মেলা বন্ধ করে দেব। করোনাকালে সরকারের বিশেষ কোনো নির্দেশনা এলে মেলা বন্ধ করে দেওয়া হবে।