শিক্ষার্থীদের আচরণে পরিবর্তন

বিলাস কান্তি দাস

| শনিবার , ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৪:২৫ পূর্বাহ্ণ

সারা বিশ্বের মত বাংলাদেশেও করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী ১৭ মার্চ, ২০২০ থেকে ধাপে ধাপে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে একটানা প্রায় দেড় বছরের অধিক সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ থেকে সংক্রমণ কমে আসায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করার ঘোষণা দেয়া হয় সরকারী প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে। সংক্ষিপ্ত পরিসরে স্বাস্থ্য বিধি মেনে ৪/৫ মাস চলার পর সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ২১ জানুয়ারি, ২০২২ থেকে পুনরায় এক মাসের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আবারো বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ থেকে অদ্যাবধি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু রয়েছে। এখন আবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশেও করোনার চোখ রাঙানি দেখা যাচ্ছে। এটিকে করোনার চতুর্থ ঢেউ বলা হচ্ছে। আজকে পর্যন্ত সংক্রমণের হার ১৬.৮৪%, যা চিন্তা ও উদ্বেগের বিষয়।
কোভিড পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় কোভিড পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের আচরণ ও মানসিক অবস্থার যে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে তা বলাই বাহুল্য। দীর্ঘ সময় ব্যবধানে ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকের পুনর্মিলন শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখার ক্ষেত্রে কতটুকু সহায়ক বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে তা ভাবার বিষয়। অনেক শিক্ষা বিশেষজ্ঞগণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার আগেই এ ব্যাপারে তাঁদের নেতিবাচক অনুভূতি ব্যক্ত করেছিলেন যা পত্র পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সুবাদে সাধারণের দৃষ্টিগোচর হয়েছে অবশ্যই। শিক্ষার্থীদের চলাফেরা, কথাবার্তা, পোশাক আশাক, পরিচ্ছন্নতা সর্বোপরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলার সাথে বর্তমানে তাদের অধিকাংশ যে মোটেই অভ্যস্থ নয় তা সাম্প্রতিক অনেকগুলি ঘটনার মাধ্যমে সবার নজরে এসেছে। বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-শিক্ষাকার্যক্রমের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দ এব্যাপারে বেশি ওয়াকিবহাল আছেন। প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে থাকার সুবাদে শিক্ষার্থীদের নিম্নোক্ত দৃশ্যমান কিছু আচরণিক পরিবর্তন ব্যক্তিগতভাবে আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে, যা সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করছি-
১. স্কুলের কার্যক্রম শুরু হওয়ার অন্তত ১৫/২০ মিনিট বা আধা ঘণ্টা আগে উপস্থিত থাকার নিয়ম থাকলেও বর্তমানে শিক্ষার্থীরা তা মানতে রাজি নয় বা উদাসীন বলে মনে হয়। এমনকি অভিভাবকদের মধ্যেও এ ব্যাপারে তেমন কোনো নজরদারী লক্ষ্য করা যাচ্ছে না, যা স্কুলের সামগ্রিক বিষয়ের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
২. পোশাক আশাক এবং পরিচ্ছন্নতার বিষয়েও শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট উদাসীনতা প্রদর্শন করছে যা অন্য শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিকভাবেই প্রভাবিত করছে। ফলশ্রুতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং এব্যাপারে কোন প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাও সংগতকারণে গ্রহণ করা যাচ্ছে না। ৩. ক্লাস চলাকালীন শিক্ষকের পাঠ গ্রহণে শিক্ষার্থীদের যথেষ্ট অনীহা পরিলক্ষিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, শিক্ষকের উপস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা ক্লাসের শৃংখলা নষ্ট করার মত দৃষ্টতা দেখাচ্ছে।
৪. শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে ক্লাস রুমের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সম্পদ নষ্ট করার মত জঘন্য মানসিকতা তৈরী হয়েছে শিক্ষার্থীদের। এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক। ৫. বিভিন্ন অজুহাতে বা অজুহাত ছাড়াই স্কুল থেকে চলে যাচ্ছে বা পালিয়ে যাচ্ছে। সংশোধনের কার্যক্রম গ্রহণ করলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের সাথে অশোভন আচরণ করছে যা সম্পূর্ণ অনভিপ্রেতই নয়, শৃঙ্খলা বিরোধীও বটে। ৬. সম্মানিত শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দের নামে দুর্ভাগ্যজনকভাবে নানা প্রকার কুৎসা রটনা করছে। যা অতীতে কোনো সময় শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা যায় নি। ৭. বিভিন্নভাবে শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কাছে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, নিপীড়ন, হেনস্তা, অপমানিত, বিপদগ্রস্ত হচ্ছে। এমনকি আপন শিক্ষার্থীর নির্দয় আঘাতে শিক্ষকের মৃত্যুবরণ করার মত দুঃখজনক ঘটনাও সাম্প্রতিককালে প্রত্যক্ষ করলাম আমরা।
৮. স্কুল ক্যাম্পাসের ভিতরে-বাইরে যে কোনো বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীরা গ্রুপিং এ জড়িয়ে পড়ছে। যা কিশোর গ্যাং নামে বর্তমানে বেশ আলোচিত একটি বিষয়। ছোট-বড় কোনো কিছুই তারা শিক্ষকদেরকে জানানোর প্রয়োজন মনে করছে না। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার মত ঘটনাও অহরহ ঘটছে।
এহেন পরিস্থিতি সামগ্রিক বিচারে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বলে মনে হয় না। বরং, এটি সমগ্র দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চিত্র বললে বোধ হয় ভুল বলা হবে না। বর্তমান এই অনভিপ্রেত পরিস্থিতি কোভিড সংক্রমণজনিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ বন্ধের কারণে সৃষ্ট কিনা, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে তা খুঁজে বের করে বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করার সময় এখনই। শিক্ষা প্রশাসনের উচ্চ পর্যায় থেকে মাঠ পর্যায়ের তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের এখনই এ বিষয়ে নজর দিতে হবে যাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশের আমূল পরিবর্তন হয়। তা যদি না হয় ভবিষ্যতে আরো চড়া মূল্য দিতে হতে পারে জাতিকে।
এ বিষয়ে আমার একান্ত ব্যক্তিগত কিছু পরামর্শ পাঠক এবং সংশ্লিষ্টদের সদয় বিবেচনার জন্য নিম্নে লিপিবদ্ধ করলাম : ১.শ্রেণিকক্ষের পাঠ গ্রহণ ছাড়া পরীক্ষায় পাশ করার কোনো সুযোগ নেই- এরকম ধারণা এবং পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের মনে জাগিয়ে তোলার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ২. সৃজনশীলতার নামে পরীক্ষার খাতায় পাঠ্যবই বহির্ভূত মনগড়া কোনো কিছু লেখার সুযোগ বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ৩. আন্দাজে কিছু লিখলে বা দাগালেও পাশ নম্বর পাওয়া যায় শিক্ষার্থীদের এ ধরনের মনোভাব পরিবর্তনে কি করা যায় তা নিয়ে নীতি নির্ধারকদের ভাবতে হবে।
৪. পরীক্ষায় পাস করার ক্ষেত্রে ক্লাসে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত উপস্থিতির বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিতে হবে, যা এখন উপবৃত্তি নির্বাচনের সময় নামে মাত্র চালু আছে। ৫. ক্লাসের আভ্যন্তরীণ ধারাবাহিক মূল্যায়নের বিষয়টিকে আরো কড়াকড়ি এবং জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা এ ব্যাপারে সচেতন হয়।
৬. কাঙ্ক্ষিত আচরণিক পরিবর্তনের জন্য বিশেষজ্ঞ প্যানেল নির্বাচন করে তাদের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং এর আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৭. ম্যানেজিং কমিটি/ গভর্নিং বডি, অভিভাবক, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে বাধ্যতামূলকভাবে নির্দিষ্ট সময় ব্যবধানে মতবিনিময় সভার আয়োজন করার বিষয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সরকারিভাবে নির্দেশনা প্রদান করতে হবে এবং এব্যাপারে উর্ধ্বতন মহলের মনিটরিং জোরদার করতে হবে। ৮. মাঠ পর্যায়ে সত্যিকার অর্থে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যাতে নিয়মিত পরিদর্শন হয় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বশীল ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে। ৯. শিক্ষকবৃন্দ পূর্বের ন্যায় নির্ভয়ে যাতে পাঠদান করতে পারেন শ্রেণিকক্ষের সেই পরিবেশ নিশ্চিত করার ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
১০. অসদাচরণে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের আইনের আওতায় এনে অভিযোগের সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ তদন্ত পূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ১১. বর্তমানে বহুল আলোচিত ছাত্র-শিক্ষক সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : প্রধান শিক্ষক, উরকিরচর উচ্চ বিদ্যালয়, রাউজান, চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধভালোবাসি প্রিয় শিক্ষককে
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে