জ্ঞান ও মননে অলংকৃত অনুপম প্রজ্ঞায় দীপ্ত সততা ও মানবপ্রেমের মহান শিক্ষাবিদ এম আবদুল মোতালেব। তিনি আনোয়ারা পশ্চিম পটিয়ার সর্ব মহলে মোতালেব মাস্টার নামেই বহুল পরিচিত। ব্যক্তিগত জীবনে অমায়িক, হাসোজ্জ্বল সৌম্যদর্শন মোতালেব স্যার যে কোন অসঙ্গতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্ভীক যোদ্ধার মত রুখে দাঁড়িয়েছেন বারবার। তাঁর একজন অনুগত ছাত্র হিসেবে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চে স্কুলের সামনে সমবেত ছাত্র-জনতাকে সাথে নিয়ে সর্বপ্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তেলনের দৃশ্যটি আজও আমাকে ভীষণ ভাবিয়ে তোলে। আমি তখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকে সমগ্র দেশের মতোই আয়োরারায় ও পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম তুঙ্গে। তখন আনোয়ারায় কোন কলেজ ছিল না। আনোয়ারা উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাই আন্দোলন সংগ্রামের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতেন। বলতে গেলে হেড স্যারের অনুপ্রেরণাই ছিল সবচেয়ে বেশি। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তৃতা দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের উৎসাহ দিয়ে বলতেন- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণে বলেছেন- এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। সুতরাং আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। এভাবেই এসে গেল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাত। ঐ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সশস্ত্র সৈনিকেরা নির্বিচারে গুলি করে হাজার হাজার নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করে। পরের দিন ২৬ শে মার্চ আমরা যথানিয়মে স্কুলে গিয়ে দেখি থানা সদরে এক থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। হেড স্যারের অফিস কক্ষে ও বাহিরে ছাত্র শিক্ষকের জটলা। শহর থেকে বেশ কয়জন ছাত্রনেতা এসেছে। তাঁরা সাথে নিয়ে এসেছে ২৫ রাতে বঙ্গবন্ধু হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হবার পূর্বে চট্টগ্রামে প্রেরিত স্বাধীনতার ঘোষণার বার্তার সাইক্লেস্টাইল কপি। মোতালেব স্যার বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার কপিটি হাতে পেয়ে প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে’, তিনি সকলকে স্কুলের সামনে সমবেত হবার আহবান জানালেন। মুহূর্তেই অন্যান্য স্যারদের ডেকে পাকিস্তানী হানাদার কর্তৃক জঘন্য হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সমাবেশ ও পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নিলেন। পতাকা তৈরির ব্যাপারে কে একজন পরামর্শও দিলেন। স্কুলের দপ্তরী অমূল্যদাকে কাগজের একটি অংকন হাতে দিযে দর্জির দোকানে পাঠিয়ে দিলেন। আধঘণ্টার মধ্যেই অমূল্য ’দা ফিরে আসলেন পতাকা নিয়ে। সবুজ জমিনে লাল সূর্য খচিত বিশাল পতাকাটি একটি লম্বা বাঁশের মাথায় বাঁধা হল। ইতিপূর্বে সেই পতাকার সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। এবার স্যারের নির্দেশ সবাই লাইনে দাঁড়াও। মিছিলের সামনে পতাকা হাতে হেড স্যার, সাথে অন্যান্য স্যার, পেছনে আমরা ছাত্র-ছাত্রীরা। দীর্ঘ এক মিছিল। মিছিলে আমাদের সিনিয়র এক ভাই উচ্চস্বরে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান ধ্বনি তুলল আমরাও সমস্বরে বলে উঠলাম ‘জয় বাংলা’। স্লোগান সমেত মিছিলটি স্কুলের সম্মুখে গোলচত্ত্বরে পৌঁছ। হেড স্যার আগের রাতের হত্যাকাণ্ডের বয়ান করে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন এবং আবারো মুহূর্মুহু জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে ধীরে ধীরে স্বাধীন বাংলার পতাকাটি তুলে ধরলেন তিনি। আমরা করতালি আর স্লোগানে ফেটে পড়লাম। নিকটেই থানা পুলিশ, মুহূর্তের মধ্যেই সমাবেশ স্থলে কয়েকজন পুলিশের উপস্থিতিতে আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। হেড স্যার পুলিশকে বুঝিয়ে বললেন। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারা দেশে হাজার হাজার বাঙালিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্বিচারে হত্যার প্রতিবাদে এই প্রতিবাদ সমাবেশ, দেশব্যাপী মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে, আমাদের সকলকে প্রতিরোধ সংগ্রামে এগিয়ে আসতে হবে। পুলিশ চলে গেল। তখন বেলা প্রায় ১২টা, সমাবেশ শেষ, আমরা চলে গেলাম নিজ নিজ বাড়িতে। এভাবে কিছুদিন গত হল, ধীরে ধীরে যেন ঝিমিয়ে পড়ল বিদ্যালয়ের সেই কোলাহল। হেড স্যারও দীর্ঘদিন স্কুলে অনুপস্থিত। জানতে পারলাম পতাকা উত্তোরণের কারণে উপরের নির্দেশে পুলিশ হেড স্যারকে খুঁজছে। আমাদের সিনিয়র ভাইদের কাউকেও দেখা যাচ্ছে না। থানা সদরে পাকিস্তান প্রেমিদের আনাগোনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এক পর্যায়ে আমাদের স্কুল একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। তারপরও কৈশোরের উদ্দীপনা নিয়ে বই খাতা বগলদাবা করে আমরা কযেক জুটি মাঝে মাঝে স্কুল প্রাঙ্গণে গিয়ে ঘুর ঘুর করতাম। আমাদের স্কুলের পাশেই প্রাথমিক বিদ্যালয়। একদিন দেখি স্কুল ভর্তি লোক। জানলাম ওরা রাজাকারের ট্রেনিং দিচ্ছে। আমরা উৎসুক হয়ে দেখলাম লেফ্ট রাইট, লেফ্ট রাইট ট্রেনিং দিচ্ছে রাজাকারেরা। জানলাম পাকিস্তানপ্রেমী এসব লোকেরা মুক্তিসংগ্রামীদের প্রতিরোধে রাজাকারী দলে যোগ দিয়েছে। তখন থেকেই আমার তরুণ মনে একুিট প্রশ্নের জন্ম হল কারা মুক্তিযোদ্ধা আর কারা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী রাজাকার, আলবদর।।
যুদ্ধ দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ল। আমাদের হেড স্যার দীর্ঘদিন ধরে বাড়িতেই আত্মগোপন করে আছেন। স্যারের বাড়ি আমাদেরই শিলাইগড়া গ্রামে। মাঝে মাঝে স্যারকে বাড়িতে গিয়ে দেখে আসতাম। সেখানে দেখতাম আমাদের সিনিয়র ভাইদের অনেকেই, ওরা স্যারের সাথে বসে কি যেনো আলাপ আলোচনা করতেন, আবার চলে যেতেন। এরাই ছিল সে সময়ের ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মী। পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে ওরাই মিচিলের নেতৃত্ব দিতেন, সভা সমাবেশে বক্তৃতা দিতেন। ওদের প্রত্যেকেই ছিল আমার চেনা, বয়স কম হলেও তাদের এসব আন্দোলন সংগ্রামে আমরাও জড়িয়ে পড়েছিলাম। মিছিল মিটিং-এ স্লোগান দিতাম, যে কারণে আমি তাঁদের স্নেহের পাত্র। এঁদের মধ্যে ইদ্রিচ আনোয়ারী, কাজী সিরাজ, আবুল কাসেম, জামাল খান, ভূপাল দাশগুপ্ত, প্রণব সেন, আবদুল মান্নান, সিরাজুল ইসলাম, মফিজ উদ্দিন, অলি আহমেদ, পঞ্চানন চৌধুরী, তরুণী সেন মিত্র, দ্বিনবন্ধু মিত্র, দীপংকর চক্রবর্তী, মিলন মিত্র, ফজল করিম, নুরুল ইসলাম, জিয়া উদ্দিন,কামাল উদ্দিন, কাজল মিত্র সহ আরো অনেকে। সেদিন এরাই ভারত ও স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে অস্ত্র হাতে পাকিস্তানি হানাদার ও এদেশীয় রাজাকার, আলবদরদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। আনোয়ারা থানার মুক্তিযোদ্ধাদের দীর্ঘ তালিকায় বড় একটি অংশই মোতালেব স্যারের ছাত্র। সে কারণে স্বাধীনতা সংগ্রামকালে স্যারের বাড়িটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অঘোষিত ক্যাম্প।
মোতালেব স্যার ১৯৩৪ সালের ১লা জুলাই আনোয়ারা থানার শিলাইগড়া গ্রামের সম্ভ্রান্ত কালাসর্দার বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মুহাম্মদ আবদুল হাকিম ও মাতার নাম মোছাম্মদ ছমন খাতুন। ১৯৫০ সালে আনোয়ারা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ভতি হন কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজে। কলেজে অধ্যয়নকালে শুরু হয় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। সেই আন্দোলন সংগ্রামে তিনি নেতৃত্বে থেকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৫৫ সালে একই কলেজ থেকে বি,এ ডিগ্রি লাভ করেন। বি.এ ডিগ্রি নেওয়ার সাথে সাথেই তিনি বটতলী এস.এম. আউলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এ সময়ে সরকারি বেসরকারি অনেক লোভনীয় চাকরির সুযোগ পেলেও তিনি শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত থাকাকালে ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে বি.এড ডিগ্রি লাভ করেন। বটতলী এস. এম আউলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকালে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সুনাম অর্জন এবং উক্ত বিদ্যালয়টিকে একটি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপদান করেন।
কিছু দিন পরেই তিনি চলে আসেন কৈনপুরা উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং পরবর্তীতে চাতরী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকালে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে খ্যাতির শিখড়ে পৌঁছেন। পরবর্তীতে আনোয়ারা মডেল হাই স্কুলে ১৯৬৭ থেকে ৮০ সাল পর্যন্ত ১৩ বছর প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালনকালে এলাকায় আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে তিনি ব্যাপক অবদান রেখেছেন। এই বিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্রদের অনেকেই আজ দেশবরেণ্য কৃতী সন্তান।
১৯৮৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর তিনি হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ৩৭তম মৃত্যু দিবসে স্যারের আত্মার প্রতি আমাদের অনেক অনেক শ্রদ্ধা রইল।
লেখক : গবেষক ও প্রকাশক