‘বাদশাহ আলমগীর, কুমারে পড়াইত এক মৌলভী দিল্লীর’– কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতাটি যারা পড়েছি, তারা খুব সহজেই বুঝতে পারি শিক্ষকের মর্যাদাকে প্রাধান্য দিতে একজন অভিভাবকের কর্তব্য ও দায়িত্ব কতটুকু! একজন শিক্ষক দেশ ও দশের শ্রদ্ধার পাত্র। ‘শিক্ষক–ছাত্র–অভিভাবক’ এই সম্পর্ক অটুট রাখার পেছনে তিন জনেরই ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তবে সমাজ বা রাষ্ট্রের উদাসীনতাকে প্রশ্রয় দিলে চলবে না। তাদেরও বিরাট ভূমিকা রয়েছে। অনেকেই শিক্ষাব্যবস্থা বা ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কের কথা বলে যুগের তুলনা দেন। সেকাল–একাল ভাগ করে দেখান। আমার মতে, শিক্ষক–শিক্ষকই। তার কোনো কাল নেই। তিনি সর্বকালের সর্বজন শ্রদ্ধেয়। শিক্ষকের প্রখর জ্ঞান, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা একটি দেশের উন্নতির প্রধান চাবিকাঠি। তাই কোনো দেশকে ধ্বংস করতে হলে সেদেশের শিক্ষক শ্রেণিকে প্রথম টার্গেট করা হয়। অতীতে এবং বর্তমানেও। আমরা এসব জানি। তবুও অন্ধ আধুনিকতার হাত ধরে, ডিজিটাল যুগের নাম করে আমরা আমাদের জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেচনাকে অন্ধকারে বিসর্জন দিতে বসেছি। আজ এদেশে বাদশাহ আলমগীর নেই। নেই তার সেই সন্তানও। যিনি শিক্ষাগুরুর পায়ে পানি ঢেলে দেয়া সত্ত্বেও পিতার কাছে অবিবেচক সাব্যস্ত হয়েছিলেন। কেননা গুরুর পায়ে নিজ হাত দিয়ে পরিষ্কার করে দেননি বলে! আমাদের সন্তানদের আমরা কী শিক্ষা দিচ্ছি? টাকা, গাড়ি, বাড়ি, বৈভব এসব থাকলে আর কিছু লাগে না। ভাবটা এমন যেন টাকা দিচ্ছি, প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকরা পড়াতে বাধ্য। নৈতিক শিক্ষার বইয়ে পড়েছি– ‘আরুনি নামের এক ছাত্রকে আল পথের পানি বন্ধ করে আসতে বলায় সে গুরুর আদেশ পালন করতে সারা রাত আলপথের উপর শুয়েছিল। কিন্তু এখনকার ছাত্রকে অমন আদেশ করলে অভিভাবকই তেড়ে আসবেন। ‘একলব্য’র গুরুদক্ষিণায়’–একলব্য গুরুর আদেশ পালন করতে নিজের হাতের আঙুল কেটে গুরুকে দক্ষিণা দিয়েছিলেন। এই হচ্ছে গুরু ভক্তি। তবে আজ আমরা আঙুল কেটে গুরুদক্ষিণা দিতে বলছিনা অথবা আলের উপর শুয়ে পানি বন্ধ করতে বলছি না, আমাদের আজ শুধু এই প্রার্থনা, ‘এত কষ্ট করে যে গুরু শিক্ষা দিলেন, তাঁকে অন্ততঃ প্রাণে মেরোনা, অপমান করো না’। ধর্মে সইবে না। সব ধর্মই শান্তির কথা বলে। সবাই মিলে সেই শান্তির খোঁজে এক হও। অহংবোধ, উগ্রতা ত্যাগ করে ছাত্র –শিক্ষক–অভিভাবক এক হলে দেশ ও দশের শান্তি। আজ বাদশাহ আলমগীরের মত মহান শাসক ও অভিভাবকের বড়ই প্রয়োজন। একজন শিক্ষক সবচেয়ে সম্মানিত ব্যাক্তি। তিনি একজন অভিভাবক ও। তাই গুটি কতক আগাছার জন্য আমরা পুরো ছাত্র–শিক্ষক–অভিভাবককে দোষারোপ করতে পারি না। তবে এখনো সময় আছে। চলুন আমরা সর্বোচ্চ শিক্ষাটা আমাদের সন্তানদের দিই। শিক্ষকদের পাশাপাশি আমরাও তাদের নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করি। শিক্ষক–শিক্ষার্থীর পবিত্র ও স্নেহের সম্পর্কটাকে শত্রুতায় পরিণত না করি। তবেই এমন অহিতকর ও কলংকিত অধ্যায়ের আর পুনরাবৃত্তি ঘটবেনা!