কথায় কথায় ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’ বলা হলেও শিক্ষকদের মেরুদণ্ড এখনো নড়বড়ে। অভাব-অনটন সিংহভাগ শিক্ষকের নিত্যসঙ্গী। সমাজে ও রাষ্ট্রে অবহেলিত ও বঞ্চিত শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা নেই। বিজ্ঞানভিত্তিক একমুখী গণবান্ধব শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন হলে শিক্ষকদের পদে পদে লাঞ্ছনা, নিপীড়িন- নির্যাতন ও খুনখারাবির শিকার হতে হতো না।
স্বাধীনতার খুব অল্পসময়ের মধ্যে ড. কুদরাত-এ খুদার নেতৃত্বে জাতি একটি যুগান্তকারী শিক্ষানীতি পেলেও তা বাস্তবায়নের সুযোগ হয়নি। ১৯৭৪ সালে এ শিক্ষানীতি জাতীয় সংসদে পাশ হলেও পরের বছরই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে পরিবর্তিত জঙ্গি পরিস্থিতি সেই শিক্ষানীতিকে ধারণ করেনি। বাস্তবতা হচ্ছে, আজ পর্যন্ত কোনো সরকারই তাদের প্রণীত শিক্ষানীতি পরিপূর্ণভাবে কার্যকর করেনি। ফলশ্রুতিতে নতুন প্রজন্ম সুশিক্ষায় শিক্ষিত ও সৃজনশীল সুনাগরিক হয়ে গড়ে ওঠছে না। ভালো শিক্ষক, কারিকুলাম নেই, নেই ভালো পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষার অনুকূল আবেষ্টনি। দেশে শিক্ষিতের হার বাড়লেও লেখাপড়া জানা লোকের সংখ্যা বাড়ছে না। কালক্রমে শিক্ষা হয়ে পড়েছে মুখস্থ নির্ভর, পরীক্ষাসর্বস্ব ও সনদমুখী। জ্ঞানঅর্জন গুরুত্ব পাচ্ছে না কোথাও। শিক্ষকতা এখন ব্রত নয়, অন্যদশটি পেশার মতো শিক্ষকতাও এখন আয়-রোজগারের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। সর্বজনীন, বৈষম্যহীন, একই ধারার বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে শিক্ষাকে করা হয়েছে বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যকীকরণ। এর নেতিবাচক প্রভাবে দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা সর্বস্তরেই চলছে চরম নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা। খোলাবাজারে শিক্ষা নিয়ে চলছে ব্যবসা। জ্যামিতিক হারে বাড়ছে বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়।
কোথাও নেই স্বচ্ছতা ও জবাদিহিতা। শিক্ষার ব্যাপারে রাজনৈতিক নেতাদের সুদৃঢ় অঙ্গিকার না থাকা, উন্নয়ন মানে যে অবকাঠামোগত উন্নয়নের বদলে উন্নয়ন যারা করবে তাদের মনন ও জ্ঞানের উন্নয়ন- সেটা বোঝতে না পারা কিংবা না বোঝা, মানসম্মত শিক্ষা-ই যে একটি জাতি গঠনের মূল ভিত্তি- তা গুরুত্বসহকারে বঙ্গবন্ধুর মতো আমলে নেয়া হয়নি বলে আজ এ দুরবস্থা। সমাজে সভ্যতা, মানবিকতা ও মূল্যবোধের যে চরম সঙ্কট ঘনিভূত হচ্ছে, তা জাতিকে মস্তবড় বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এখনই এ অবস্থা থেকে জাতিকে বাঁচানোর উপায় খোঁজে বের করে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করা না হলে আমরা কেউ নিরাপদ থাকতে পারবো না।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের আমরা অসাম্প্রদায়িক ও কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারছি না বলে দেশে সাম্প্রদায়িকতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। মানুষের আচরণ ক্রমশ অসহিষ্ণু, অসংযত ও সহিংস হয়ে যাচ্ছে। অন্ধবিশ্বাস ও আবেগে ডুবে আছে তরুণ সমাজের একটি অংশ। বর্তমানে আমাদের সমাজে, সমাজ নিয়ন্ত্রণে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ ক্ষমতার বিভিন্ন পর্যায়ে এমনসব মানুষ জায়গা করে নিয়েছে, যাদের হিতাহিত জ্ঞান নেই, লেখাপড়ার জোর নেই, ভালো-মন্দের পার্থক্যটাও বোঝতে চায় না-সেই সমাজে যেসব শিক্ষক মুক্তচিন্তার কথা বলেন, নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার কথা বলেন, সহিংসতা আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চান, তাঁদের অবস্থা কী হবে- তা তো সহজেই অনুমেয়। সম্প্রতি বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে যেতে হলো কারাগারে। পুলিশের নাকের ডগায় জুতোর মালা পরানো হলো এক শিক্ষককে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আনার অভিযোগে। প্রাণ ভয়ে পালিয়ে থাকতে হয়েছে, শেষমেশ প্রাণ রক্ষা হয়েছে ওই শিক্ষকের।
আইন প্রয়োগে কঠোর হওয়ায় আশুলিয়ার এক শিক্ষককে স্কুল কমিটির প্রতাপশালী সভাপতির নাতির স্ট্যাম্প এর আঘাতে পরপারে পাড়ি জমাতে হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতার সহজ শিকার সংখ্যালঘু শিক্ষকেরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে তেমন একটা নেই, অন্যরা নিয়ন্ত্রণ করেন বলে শিক্ষকদের মান-মর্যাদা তলানিতে প্রায়। মানুষগড়ার কারিগর হিসেবে সমাজে শিক্ষকদের প্রভাব-প্রতিপত্তি নেই বললে চলে। এ কারণে শিক্ষকদের ওপর চলছে নিগ্রহ ও নিষ্ঠুরতা। সরকার এ দায় এড়াতে পারে না। এ অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে।