শাহ্‌সূফী মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল জব্বার (রাহ.) স্মরণে

মুহাম্মদ জাফর উল্লাহ্‌ | বুধবার , ৩০ মার্চ, ২০২২ at ১০:৫০ পূর্বাহ্ণ

বায়তুশ শরফের আধ্যাত্মিক অনুশীলন তথা তরীকতে আলীয়ায়ে কাদেরীয়ার ব্যাপক প্রচার-প্রসার এবং জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমকে মানুষের দুয়ারে পৌঁছে দেয়ার অপরিসীম দায়িত্ব পালনে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন যিনি, তিনি হলেন শাহ্‌ সূফী হযরত মাওলানা মীর মোহাম্মদ আখতর (রাহ.)-এর খলীফায়ে আজম হাদিয়ে যামান শাহ সূফী আল্লামা হযরত মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল জব্বার (রাহ.)। এই মহান অলি ১৯৩৩ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি আপার বার্মার থাংগু জেলার পিনজুলুক রেলওয়ে স্টেশনের সন্নিকটে বাঙ্গালি কলোনীতে জন্মগ্রহণ করেন। সাতকানিয়া উপজেলার গারাঙ্গিয়া আলিয়া মাদরাসা হতে ফাযিল পাঠ সমাপ্ত করে চট্টগ্রামের দারুল উলুম আলিয়া মাদরাসায় কামিল শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং ১৯৫৩ সালে কৃতিত্বের সাথে কামিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ সময়ে বায়তুশ শরফের প্রাণ প্রতিষ্ঠাতা কুতুবুল আলম শাহ্‌ সূফী হযরত মাওলানা মীর মোহাম্মদ আখতর ছাহেব (রাহ.) ছিলেন তাঁর প্রকৃত অভিভাবক। বাল্যকাল হতেই তিনি কঠোর অধ্যবসায়ী, প্রখর স্মরণ শক্তি ও মেধাসম্পন্ন ছাত্র ছিলেন। পবিত্র কুরআন ও হাদিসের মূল আরবিসহ অনুবাদ ও ব্যাখ্যা বিভিন্ন মজলিস-মাহফিলে ঘন্টার পর ঘন্টা তিনি বর্ণনা করতে পারতেন। আলিম শ্রেণির ছাত্র অবস্থায় ১৯৪৭ সালে পবিত্র শবে বরাত রজনীতে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন মসজিদের হুজরাখানায় হযরত কেবলা শাহ্‌ মীর মোহাম্মদ আখতর (রাহ.)- এর হাতে তিনি বায়াত হন এবং তাঁর একান্ত নেকনজরে থেকে তরীকায়ে আলীয়ায়ে কাদেরীয়ার আধ্যাত্মিক সাধনায় ব্রতি হন। ১ জানুয়ারি ১৯৫৪ হতে ৩১শে জানুয়ারি ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত একটানা ১৪ বছর তিনি পাঁচলাইশ ওয়াজেদীয়া আলিয়া মাদরাসার মুহাদ্দিস ছিলেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে তিনি সাধারণ মানুষকে সৎপথ প্রদর্শন করেন। হযরত কেবলা (রাহ.)-এর নির্দেশে তিনি চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন মসজিদে বহু বছর খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৮ হতে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি পীর-মুর্শিদের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে থাকেন। তাঁর পীর ছাহেব মীর মোহাম্মদ আখতর (রাহ.) জীবনের ২৯তম হজ্বব্রত পালনের পর ১৯৭১ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি মক্কা শরীফের মিনা হাসপাতালে ইন্তেকাল করলে পীর মুর্শিদের মনোনয়নক্রমে তিনি বায়তুশ শরফ দরবারের একমাত্র খলীফা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
বায়তুশ শরফ দরবারের খেলাফত প্রাপ্তির পর তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশসহ মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকায় “বায়তুশ শরফ আন্‌জুমনে ইত্তেহাদ বাংলাদেশ” এর অসংখ্য শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৬০টি মসজিদ বায়তুশ শরফ, ১৩টি এতিমখানা, ১০টি হেফযখানা, ঢাকার ফার্মগেটে বায়তুশ শরফ দারুশ শেফা হাসপাতালসহ ৩টি হাসপাতাল, ১টি ইসলামী গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ১৮৮টি দ্বীনি তালিম কেন্দ্র, চট্টগ্রাম বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল মাদরাসাসহ ১০টি মাদরাসা, ৫টি প্রাইমারী স্কুল, ৩২টি ফোরকানিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। কঙবাজারে তিনি একটি স্কুল, একটি এতিমখানা ও মাদ্রাসা, একটি শিশু হাসপাতাল ও একটি অত্যাধুনিক চক্ষু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি ছিলেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক। আমরণ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এর প্রথম বোর্ড অব ডাইরেকটরসের ভাইস চেয়ারম্যান ও শরীয়া কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি স্যোসাল ইসলামী ব্যাংক লিঃ এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ও শরীয়াহ কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লিঃ প্রতিষ্ঠায়ও তিনি আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেন। আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য তিনি বিশেষ অবদান রাখেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাথমিক খরচ নির্বাহে তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। এর প্রথম কম্পিউটার ল্যাবটি তাঁর একক অনুদানে প্রতিষ্ঠিত।
আশির দশকে ‘ইত্তেহাদুল উম্মাহ্‌ বাংলাদেশ’ এর তিনি ছিলেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ‘মজলিসুল ওলামা বাংলাদেশ’ এর তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। শরীয়ত বিরোধী কর্মকাণ্ডকে কখনো প্রশ্রয় দেননি কোন অজুহাতে। যেখানে সম্ভব হয়েছে তাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন হেকমতের সাথে। ফলে লোহাগাড়া শাহ্‌পীর আওলিয়া (রাহ.)-এর মাযারে ওরশ-এর নামে শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপ তাঁরই হস্তক্ষেপে বন্ধ হয়ে শরীয়ত মোতাবেক মাহফিলের সূচনা হয়। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় লোহাগাড়া বড়হাতিয়ায় তিনদিন ব্যাপী বলিখেলা, গরুর লড়াইয়ের নামে ব্যভিচার -অশ্লীল কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে সেখানে ‘জবলে সিরাত’ মাহফিলের সূচনা হয়। বাগেরহাট ষাট গম্বুজ মসজিদ ও খানজাহান আলী (রাহ.) মাযারে অনুষ্ঠিত চৈত্র পূর্ণিমার তিনদিন তিনরাতব্যাপী জাহেলি যুগের প্রচলিত অনুষ্ঠানের মত যে সব শরীয়ত বিরোধী অনুষ্ঠান চলে আসছিল, তা মহান মোর্শেদ শাহ্‌ জব্বার (রাহ.) এর পদার্পণে ইসলামী অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সেখানকার ওলামা মাশায়েখদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে শিরক ও বিদআত বিরোধী নব জাগরণ। তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় ৬০ গম্বুজ মসজিদে রীতিমত আযান- নামায পুনঃ চালু হয়। ৬০ গম্বুজ মসজিদ সংলগ্ন মাঠের পাশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বায়তুশ শরফ এতিমখানা, হেফযখানা ও আলিম মাদরাসা। বিগত প্রায় ৪৫ বছর ধরে সেখানে অনুষ্ঠিত ৩ দিন ব্যাপী ঈসালে ছাওয়াব মাহফিল হয়ে আসছে এর সব খরচ বহন করে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় বায়তুশ শরফ।
দুর্গত মানুষের পরম বন্ধু ছিলেন তিনি। ১৯৭৮, ৮০ এবং ৮৮, ৮৯ ও ৯২ সালে আরাকানের নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলমানদের সাহায্যার্থে ছুটে গিয়েছেন কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফে। ১৯৮৫ সালে সন্‌দ্বীপের উড়িরচর, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে, ১৯৮৭ সালে চকরিয়ায়, ১৯৮৮ সালে ঢাকার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, ১৯৯১ সালে ১৯৯৬ সালের সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, প্রবল বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত সর্বহারা মানুষের সাহায্যের জন্য তিনি লক্ষ লক্ষ টাকার ত্রাণসামগ্রী নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন।
শাহ্‌ আবদুল জব্বার (রহ.) ছিলেন একজন সফল লেখক, অনুবাদক ও সুবক্তা। তাঁর ২০টি বই সর্বসাধাণেকে সত্যপথের সন্ধান দিয়েছে। বায়তুশ শরফ ইসলামী গবেষণা প্রতিষ্ঠান তাঁর প্রজ্ঞার বাস্তব নিদর্শণ। ১৯৮৫ সালে তিনব্যাপী অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশে ইসলাম’ বিষয়ক সেমিনার এখনো গবেষকগণ পরম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।
১৯৯৭ সালে হজ্ব পালন করতে যেয়ে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেটি ছিল তাঁর জীবনের ৩৩তম হজ্ব পালন। লক্ষ লক্ষ ভক্ত-অনুরক্তকে শোক সাগরে ভাসিয়ে এতিম অসহায় দুঃস্থ মানবতার সেবক ও আধ্যাত্মিক সাধক, বায়তুশ শরফের পরম শ্রদ্ধেয় পীর ছাহেব, মুরশিদে বরহক, হাদীয়ে যামান শাহ্‌ সূফী আলহাজ্ব হযরত মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল জব্বার ২৫শে মার্চ ১৯৯৮ বুধবার সকাল ৭টা ১৫ মিঃ বন্দর নগরী চট্টগ্রামের ধনিয়ালাপাড়াস্থ তাঁর হুজরাখানায় ইন্তেকাল করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৫ বৎসর। ২৬শে মার্চ ১৯৯৮, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম রেলওয়ে পলোগ্রাউণ্ড ময়দানে লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তাঁর পবিত্র নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়।
জানাযায় ইমামতী করেন তাঁরই সুযোগ্যপুত্র বায়তুশ শরফের বর্তমান রাহবার আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ আবদুল হাই নদভী (ম.জি.আ.)। দুপুর সাড়ে ১২ টায় বায়তুশ শরফ কেন্দ্রীয় মসজিদের দক্ষিণ পাশে তাঁকে চিরসমাহিত করা হয়। এটি ছিল তাঁর হাতে গড়া একটি সুন্দর ফুল বাগান। এখানে তিনি মৌমাছি চাষ করে মধু সংগ্রহ করতেন। একসময় এই বাগানে দু’টি হরিণও লালন পালন করতেন।
লেখক : সম্পাদক, মাসিক দ্বীন দুনিয়া ও শিশু কিশোর দ্বীন দুনিয়া

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রিয় স্বদেশ বাংলাদেশ
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে