পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় আটক নগর বিএনপির আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেনসহ দলটির ১৭ নেতকর্মীকে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। গতকাল মঙ্গলবার মহানগর হাকিম সরোয়ার জাহানের আদালত শুনানি শেষে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এর আগে সোমবার বিকেলে নগরের নাসিমন ভবন দলীয় কার্যালয়ের সামনে কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে মিছিল ও সমাবেশ করার সময় পুলিশের সাথে বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবকদলের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়েছে। সড়কে আগুন দেয় বিএনপির নেতাকর্মীরা। পুলিশ কয়েক রাউন্ড শটগানের গুলি ও রাবার বুলেট ছোড়ে। সংঘর্ষে ৬ পুলিশ সদস্য ও বিএনপির অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। ঘটনাস্থল থেকে নগর মহিলা দলের সভাপতি মনোয়ারা বেগম মনিসহ ১৫ জনকে আটক করা হয়। পরে নিজের মালিকানাধীন ট্রিটমেন্ট হাসপাতাল থেকে ডা. শাহাদাত হোসেন ও তার পিএস মারুফুল হককে আটক করা হয়। এদিকে ওইদিনই বিএনপি কার্যালয়ে তালা দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন বিএনপির নেতারা।
সংঘর্ষের ঘটনায় কোতোয়ালী থানায় দণ্ডবিধি, বিস্ফোরক দ্রব্য ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। মামলা দুটিতে শাহাদাত, নগর বিএনপির সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর, দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান ও কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীমসহ ১০১ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ৯০ থেকে ১১০ জনকে আসামি করা হয়।
সোমবার আটকের পর পুলিশ শাহাদাতকে চকবাজার থানায় বিএনপি নেত্রীর করা চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেপ্তারের দাবি করে। তবে গতকাল পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে সংঘর্ষের ঘটনায় দায়ের হওয়া দুটি মামলায়ও গ্রেপ্তার দেখানোর আদেশ দেয় আদালত।
সেদিন কী ঘটেছিল : প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সোমবার বিকেল সোয়া ৩টার দিকে কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম ও নগর বিএনপির সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্করের নেতৃত্বে তিনপুলের মাথা এলাকা থেকে বিএনপি ও স্বেচ্ছাসেবক দলের একটি মিছিল দলীয় কার্যালয়ের সামনে নূর আহম্মেদ সড়কে এসে সমাবেশ শুরু করে। এ সময় রাস্তার মাঝখানে সমাবেশ করায় বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল।
সমাবেশে যোগ দেওয়ার জন্য কাজির দেউড়ি থেকে দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ছাত্রদলের একটি মিছিল আসে। তাদের পেছনে ছিল নগর বিএনপির আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেনের নেত্বত্বে যুবদলের আরেকটি মিছিল। আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে আসা মিছিলকে এসএ পরিবহনের সামনে বাধা দেয় পুলিশ। এতে উভয় পক্ষে ধস্তাধস্তি হয়। বাধা ডিঙিয়ে মিছিলকারীরা সামনের দিকে চলে এলে পেছন থেকে লাঠিচার্জ শুরু করে পুলিশ। এদিকে মূল সমাবেশ থেকে দলের নেতাকর্মীরা এগিয়ে যায় পুলিশের দিকে। এতে সংঘর্ষ লেগে যায় দুই পক্ষে। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয় উভয় পক্ষে। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে কাজির দেউড়ি মোড় পর্যন্ত।
সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশকে ইট-পাটকেল, ডাবের খোসা নিক্ষেপ করেন বিএনপির কর্মীরা। রাস্তার পাশে থাকা বিভিন্ন জিনিসপত্র এবং একটি মোটরসাইকেলে আগুন দেয়। কয়েকটি মোটরসাইকেলও ভাঙচুর করেন বিএনপিকর্মীরা। তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের হেলমেট ও কাজীর দেউড়ি পুলিশ বঙ ভাঙারও অভিযোগ আছে।
এ সময় নেভাল মোড়ে পূর্বে থেকে অবস্থানরত পুলিশ টিয়ার সেল নিক্ষেপ করে। কিছুক্ষণের মধ্যে যোগ দেয় অতিরিক্ত পুলিশ। এ সময় কয়েক রাউন্ড শটগানের গুলি ও রাবার বুলেট ছোঁড়ে পুলিশ। এতে ছত্রভঙ্গ হন বিএনপির নেতাকর্মীরা। অনেকে পালিয়ে যান, অনেকে আশ্রয় নেন দলীয় কার্যালয়ে। পরে পুলিশ দলীয় কার্যালয় থেকে ১৬ জনকে আটক করে। এদিকে ফায়ার সার্ভিসের টিম এসে রাস্তায় দেওয়া আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। প্রায় এক ঘণ্টা পর পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে আসে।
৬ পুলিশ আহত : সংঘর্ষে দামপাড়া পুলিশ লাইনের রিজার্ভ ফোর্সের কনস্টেবল প্রিয়াংকা মল্লিক, রিজার্ভ ফোর্সের উপ-পরিদর্শক (এসআই) শেখ মোহাম্মদ ইব্রাহিম, একজন ট্রাফিক কনস্টেবলসহ ৬ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে প্রিয়াংকার মুখে মারাত্মক জখম হয়েছে। পুলিশের দাবি, বিএনপির কর্মীরা ইট দিয়ে আঘাত করে প্রিয়াংকার মুখ থেতলে দিয়েছেন।
বিএনপির অর্ধশতাধিক আহত : সংঘর্ষে সংগঠনের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন বিএনপি নেতারা। এর মধ্যে যুবদল নেতা তৈয়ব আলী, কিং মোতালেব, আনিসুজ্জামান, আবদুর রহিম, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক জিয়াউর রহমান জিয়া, নগর ছাত্রদলের আহ্বায়ক সাইফুল আলম, যুবদলের হায়দার হোসেন, মো. হেলাল, সাহাবুদ্দিন সবু, শাহেদ তৈমুর, ইসহাক খান, মো. সবুজ, মো. বাবু, মনজুর আলম, মো. ইলিয়াসকে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সংঘর্ষের পর বিএনপি কার্যালয়ে আশ্রয় নেওয়া রক্তাক্ত অবস্থায় একজনকে উদ্ধার করে পুলিশ হাসপাতালে নিয়ে যায়। ওই ব্যক্তি নিজেকে দিনমজুর দাবি করলেও পুলিশ জানায় সে বিএনপির কর্মী।
পুলিশের বক্তব্য : ঘটনার পর নগর পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) এসএম মেহেদী হাসান সাংবাদিকদের বলেন, পরিকল্পনা করে বিএনপির কর্মীরা পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে। সেখানে শিবির কর্মীরাও অংশ নিয়েছিল। অরাজকতা তৈরির জন্য কোনো কারণ ছাড়াই মিছিল থেকে পুলিশের ওপর হামলা চালায়। ফুটপাতের বিভিন্ন জিনিসপত্রে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং ভাঙচুর শুরু করে।
কোতোয়ালী থানার ওসি মো. নেজাম উদ্দীন বলেন, সড়ক অবরোধ করে তারা সমাবেশ করে। এতে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে আমরা সড়ক ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করি। কিন্তু তারা আচমকা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। বৃষ্টির মতো ইট আর পাথর ছুড়েছে। বাধ্য হয়ে আমরা ফাঁকা গুলি করেছি।
বিএনপির বক্তব্য : বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক (চট্টগ্রাম বিভাগ) মাহবুবের রহমান শামীম আজাদীকে বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল হয়েছে। বিনা উসকানিতে পুলিশ লাঠিচার্জ করেছে, টিয়ারসেল ও গুলি করেছে। আমাদের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে আহত করেছে। দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করেছে। এটা নিন্দনীয়। যাদের আটক করেছে তাদের মুক্তি দাবি করছি।
দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান আজাদীকে বলেন, মিছিল নিয়ে সমাবেশে যাওয়ার সময় কোনো কথা ছাড়াই পুলিশ গুলি করতে শুরু করে। আমাদের মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দেয়। আমরা সমাবেশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারিনি।
নগর বিএনপির সাবেক সহ-দপ্তর সম্পাদক ইদ্রিস আলী আজাদীকে বলেন, কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচি ছিল আমাদের। পুলিশের অনুমতিও ছিল। এরপরও বিনা কারণে লাঠিচার্জ ও গুলি চালিয়ে ৫০ জনের বেশি নেতাকর্মীকে আহত করে।
কারাগারে ১৭ জন : ডা. শাহাদাত ছাড়াও গতকাল কারাগারে প্রেরণ করা অন্য আসামিরা হচ্ছেন শাহাদাতের পিএস মারুফুল হক (৪০), মো. ফিরোজ (৩৪), তারেক আজিজ (২৪), আবু বক্কর সিদ্দিক (৩৫), সাঈদ তানজিম মাহমুদ (২০), আব্দুর রহিম প্রকাশ মিনার রহিম (২২), আলী আকবর হোসেন (১৯), লিটন (২২), হায়দার হোসেন (৪১), সাকিব হোসেন (১৯), মনোয়ারা বেগম মনি (৫২), আঁখি সুলতানা (৪২), দেওয়ান মাহমুদা আক্তার লিটা (৩৫), রিনা বেগম (৪০), ফাতিমা কাজল (৩৫) ও কিং মোতালেব (৪২)।
রিমান্ড শুনানি আজ : গতকাল বিকেলে কোতোয়ালী থানা থেকে বিশেষ নিরাপত্তায় শাহাদাতসহ ধৃত বিএনপি নেতাকর্মীদের আদালতে আনা হয়। শাহাদাত ছাড়া বাকিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৭ দিন করে রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ। তবে নেতাকর্মীদের রিমান্ড বাতিল ও জামিন চেয়ে দুটি এবং শাহাদাতের পক্ষে ডিভিশন, সুচিকিৎসা চেয়ে দুটিসহ আদালতের কাছে পৃথক চারটি আবেদন করেন বিএনপির আইনজীবীরা।
নগর পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (প্রসিকিউশন) শাহাবুদ্দিন আহমদ বলেন, চকবাজার থানায় বিএনপির এক নারীনেত্রীর করা মামলায় গ্রেপ্তার করা হলেও ডা. শাহাদাতকে পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে এ দুটি মামলায়ও গ্রেপ্তার দেখানোর আদেশ দেন বিচারক।
তিনি বলেন, কোতোয়ালী থানার পৃথক এ দুই মামলায় ডা. শাহাদাত হোসেন ছাড়া বাকি ১৬ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে আদালতের কাছে ৭ দিন করে রিমান্ড চেয়ে আবেদন করা হয়। এছাড়া গ্রেপ্তার নেতাকর্মীদের পক্ষে তাদের আইনজীবীরা পৃথক চারটি আবেদন করেন। পুলিশের রিমান্ড আবেদন ও এর বিপক্ষে বিএনপির আইনজীবীদের আবেদনসহ অন্য আবেদন বিষয়ে শুনানি হয়নি। বুধবার শুনানির দিন ধার্য করে আদালত।