সকাল নয়টা থেকেই চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে মঞ্চ প্রস্তুত। শেষ বারের মতো আসবেন এখানে মুক্তিযুদ্ধের শব্দসৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, উদীচী চট্টগ্রামের সভাপতি শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফী। জীবনে বহুবার শহীদ মিনারে এসেছেন তিনি। বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা, চেয়েছেন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি। তিনি বিশ্বাস করতেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে কোন আপোষ চলে না। সাড়ে নয়টায় এলেন তিনি। তবে অন্যান্যবারের চেয়ে এবারে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে তাঁর আসাটা ভিন্ন। এবার তিনি এসেছেন কফিনে মোড়া শবদেহ হয়ে। তাঁর জন্য অপেক্ষায় শত শত মানুষ। শেষবারের মতো তাঁকে দেখার অপেক্ষায় তারা। মুশতারী শফী এলেন, ফুলে ফুলে ছেয়ে গেল তাঁর কফিন। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এ এস এম জামশেদ খোন্দকারের নেতৃত্বে বেগম মুশতারী শফীকে গার্ড অব অনার দেয় পুলিশের একটি চৌকস দল। এসময় তাঁর কফিন লাল-সবুজের জাতীয় পতাকায় মুড়িয়ে দেওয়া হয়। মুশতারী শফী তাঁর ব্যাগে রেখে গিয়েছিলেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি বার্তা। তাঁর মেয়ে রুমানা শফী শ্রদ্ধা জানানোর কর্মসূচির মধ্যে সেই বার্তাটি যখন পড়ে শোনাচ্ছিলেন, তখন উপস্থিত সকলেই হাত উঁচিয়ে সেই শপথে বলীয়ান হন। রুমানা শফী জানান, মুশতারী শফীর ব্যাগ থেকে পেয়েছেন নিজ হাতে লেখা চিরকুটটি। তাতে লেখা, ‘এখন প্রতিবাদ চাই। প্রতিরোধ চাই। চাই রাজনৈতিক আদর্শিক সংগ্রাম। যারা ১৯৭১ এ নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে এবং নৃশংসভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, সে খুনিদের সাথে কোনো আপোষ হতে পারে না। এবার বুদ্ধিজীবী দিবসে আমাদের এই অঙ্গীকার হোক। অতীতের সব ত্রুটি-বিচ্যুতি ঝেড়ে ফেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দেশে প্রতিষ্ঠিত হোক।’
সকাল সাড়ে ৯টায় নগরীর এনায়েত বাজারের মুশতারী লজ থেকে প্রয়াতের মরদেহ শহীদ মিনারে নেওয়া হয়। সেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ছাত্র-যুব সংগঠনের নেতাকর্মী, জনপ্রতিনিধি, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত হন।
বেগম মুশতারী শফীর সন্তান মেহরাজ তাহসান শফী বলেন, আমার বাবাকে আমরা একাত্তরে হারিয়েছি। আমার মা অনেক কষ্ট করে আমাদের মানুষ করেছেন। তিনি শুধু পরিবারের গণ্ডির মধ্যেই আবদ্ধ থাকেননি। লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। কোনো পদক কিংবা পুরস্কারের জন্য করেননি। কিন্তু জীবিত অবস্থায় তিনি যদি রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত হতেন, আমরা শান্তি পেতাম। আমার মা যে আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথে যদি বাংলাদেশ অবিচল থাকে, আমার মায়ের আত্মা শান্তি পাবে।
উদীচী চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক শীলা দাশগুপ্তা ও সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রমেন দাশগুপ্তের পরিচালনায় শ্রদ্ধা জানিয়ে বক্তব্য দেন, কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন, চবি উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার, উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক বেণু কুমার দে, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা বালাগাত উল্লাহ, সাবেক সাংসদ চেমন আরা তৈয়ব, সিপিবি, চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক অশোক সাহা, উদীচীর সহ-সভাপতি ডা. চন্দন দাশ, ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির চট্টগ্রামের সভাপতি দেলোয়ার মজুমদার, কবি ও সাংবাদিক ওমর কায়সার ও কামরুল হাসান বাদল, জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বাবু, প্রমার সভাপতি রাশেদ হাসান, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি তপন দত্ত, চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্রের শৈবাল চৌধূরী, মহিলা পরিষদের লতিফা কবীর, আওয়ামী লীগ নেতা জামশেদুল আলম চৌধুরী, অ্যাড. ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী, বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্রের আঞ্চলিক পরিচালক এস এম মোস্তফা সরওয়ার, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের শ্যামল কুমার পালিত, বোধনের আব্দুল হালিম দোভাষ, ন্যাপ নেতা মিটুল দাশগুপ্ত।
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, চসিকের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনের পক্ষে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। খেলাঘরের কেন্দ্রীয় সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজা খানম, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. অনুপম সেন, খেলাঘরের সভাপতি পান্না কায়সারের পাঠানো শোক বিবৃতি পাঠ করা হয়েছে।
পরিবারের পক্ষে প্রয়াতের জামাতা সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও বর্তমান সাংসদ অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল নজরুল ইসলাম হিরু এবং নগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার মোজাফফর আহমেদ এসময় উপস্থিত ছিলেন। মহানগর ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম মহানগর, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড, বাকবিশিস, বোধন, প্রমা, খেলাঘর মহানগর, নাগরিক সমাজ চট্টগ্রাম, সিপিবি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, বাসদ, গণসংহতি আন্দোলন, বাম গণতান্ত্রিক জোট, গণজাগরণ মঞ্চ, উদীচী চট্টগ্রাম, প্রজন্ম ৭১, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস, অগ্নিবীণা পাঠাগার, মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা পরিষদ, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদ, গণমুক্তি ইউনিয়ন, সাম্যবাদী দল, কণ্ঠনীড়, ওডিশি অ্যান্ড টেগোর ড্যান্স মুভমেন্ট, অভ্যুদয়, ব্লাস্ট, সমাজ সমীক্ষা সংঘ, ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা, সিআরবি রক্ষা মঞ্চ, সম্মিলিত আবৃত্তি জোট, সম্মিলিত আবৃত্তি পরিষদ, ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, সিপিবি নারী সেল, মহিলা পরিষদ, বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার স্মৃতি পরিষদ, উচ্চারক, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন, নারী যোগাযোগ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন সংগঠন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়।
দুপুর পৌনে একটায় মুশতারী শফীর মরদেহ নেওয়া হয় জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদ প্রাঙ্গনে। বাদে জোহর নামাজে জানাজা শেষে তাঁকে চৈতন্যগলি কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।