শব্দ নোঙরের ইচ্ছে ছন্দে জাগুক আগামী প্রহর

সংস্কৃতি চর্চায় চট্টগ্রাম

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ২৩ নভেম্বর, ২০২১ at ১০:৩৬ পূর্বাহ্ণ

আবৃত্তি সংগঠন শব্দ নোঙর। শব্দগুলো নোঙর করে কণ্ঠে। আর সুবিন্যস্ত আকারে পংক্তিমালায় পরিণত হয় আবৃত্তিতে। এমনই একটি আবৃত্তি সংগঠনের নাম শব্দনোঙর। শব্দনোঙর শুধু আবৃত্তিই করে না, মাতৃভাষা শুদ্ধভাবে বলার লক্ষ্যে উচ্চারণেও সাধনা করে থাকে। শব্দনোঙর তিনদিনব্যাপী কাজী সব্যসাচী আবৃত্তিমেলার আসর বসাচ্ছে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির মুক্তমঞ্চে। ওরা যেমন আবৃত্তি চর্চা এবং উচ্চারণরীতিকে ঋদ্ধ করছে এই সংগঠনের মাধ্যমে, তেমনি মাতৃভাষা বাংলা শুদ্ধ করে উচ্চারণ করা ও সুন্দর কথা বলার প্রশিক্ষণও দিচ্ছে। এই বিষয়গুলো একত্রিত হয়ে আমাকে চমকিত করেছে। আবৃত্তির পথচলায় শব্দরা নোঙর ফেলেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, বর্ণমালার আগুন ঝরানো দিনে, মুক্তিযুদ্ধে, বিজয়ে, স্বাধীনতায় এবং মানবিক মূল্যবোধে। লেখক, উপস্থাপক দিলরুবা খানম সহ কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের মিলিত প্রয়াসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক সংগঠনরূপে শব্দনোঙরের যাত্রা শুরু ১৯৯৫ সালে। শুরুতে একদল বন্ধু মিলে একটু আড্ডা, গান, আর ভালোলাগার কবিতা পড়া ইত্যাদি ছিল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। পরবর্তীতে দিলরুবা খানম ও হাসান জাহাঙ্গীর ২০০৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি যথাক্রমে সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে শুধুমাত্র আবৃত্তিচর্চায় যৌথভাবে শুরু করেন শব্দনোঙরকে ঢেলে সাজানোর কার্যক্রম।
শব্দনোঙর এ পর্যন্ত প্রমিত উচ্চারণ, আবৃত্তি, উপস্থাপনা, সংবাদ পাঠ, মাইক্রোফোনের ব্যবহার, ছন্দ জ্ঞান, আবৃত্তি নির্মাণসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ৩৫টি কর্মশালার আয়োজন করেছে। সংগঠনটির ব্যতিক্রম কিন্তু প্রশংসনীয় কাজ হলো- দেশে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রথমবারের মতো সুন্দর কথা বলা ও বাংলা প্রমিত উচ্চারণ প্রতিযোগিতার আয়োজন শুরু করা। উদ্দেশ্য, শিক্ষার্থীরা যাতে প্রমিত উচ্চারণ ও সুন্দর করে কথা বলায় আগ্রহী ও সচেতন হয়। এ দুটি উদ্যোগ সর্বস্তরের বিবেকবান মানুষ- বিশেষত শিক্ষক সমাজ ও অভিভাবকদের দৃষ্টি কেড়েছে। প্রথম উচ্চারণ প্রতিযোগিতা শুরু হয় ২০১৪ সালে। ২০১৯ সালে ৫০টিরও বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। সংগঠনের প্রথম ধারাবাহিক আবৃত্তি আয়োজন ‘কবিতার কোলে কবিতার বোলে’। ২০১৩ তে আয়োজন করে দেশে প্রথমবারের মতো তিন দিনব্যাপী আবৃত্তিমেলা। এরপর থেকে হয়েছে তিনদিনব্যাপী আবৃত্তিমেলার নিয়মিত আয়োজন। ২০১৫ সালে শুরু করে শব্দনোঙর আবৃত্তি সম্মাননা এবং শব্দনোঙর ভাষা ও সাহিত্য সম্মাননা। প্রথমবার আবৃত্তিতে সম্মাননা দেয়া হয় ঢাকা থেকে আবৃত্তিশিল্পী আশরাফুল আলম এবং চট্টগ্রাম থেকে আবৃত্তিশিল্পী রনজিৎ রক্ষিতকে। সম্মাননার সম্মান বজায় রাখতে ক্রেস্টের সাথে যুক্ত করা হয় নগদ পাঁচ হাজার টাকা সম্মানী। ২০১৫ সালে আবৃত্তিমেলা উদ্বোধক ছিলেন দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। প্রধান অতিথি দেশ বরেণ্য সাংবাদিক আবেদ খান। বিভিন্ন সময় অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী ড. জামাল নজরুল ইসলাম, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. অনুপম সেন, কবি আসাদ চৌধুরী, কবি আবুল মোমেন, কবি অরুণ দাশগুপ্ত, কবি আসাদ মান্নান, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস, অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ, কথা সাহিত্যিক আনিসুল হক, প্রয়াত আবৃত্তিশিল্পী কাজী আরিফ, আবৃত্তিশিল্পী মীর বরকত, বেলায়েত হোসেন, শিমুল মুস্তাফা আবৃত্তিশিল্পী আহকাম উল্লাহ, নাট্যজন প্রদীপ দেওয়ানজী সহ বিশিষ্টজনেরা। শব্দনোঙর আবৃত্তি মেলায় প্রতিবার দেশ-বিদেশের অনেক নবীন-প্রবীণ শিল্পীরা একক আবৃত্তিতে মঞ্চ মাতান। শব্দনোঙর জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মরণে আয়োজন করেছে ‘নজরুল মেলা’। ২০১৩ সালে নিজস্ব শিল্পীদের নিয়ে ‘আঠারো কণ্ঠের একক আবৃত্তি’ পরিবেশনার আয়োজন করে। এ রকম অনুষ্ঠানও শব্দনোঙরের ব্যতিক্রমী সৃষ্টি। শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ২০১৯ সালে সর্বপ্রথম তিন দিনব্যাপী বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি মেলার আয়োজন করে। এ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন ৩০ জন কবি। আবৃত্তিতে সম্মাননা দেয়া হয় বিশিষ্ট আবৃত্তিশিল্পী ড. ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়কে এবং ভাষা ও সাহিত্য সম্মাননা দেয়া হয় ডক্টর মাহবুবুল হক ও শহীদজায়া মুক্তিযোদ্ধা বেগম মুশতারী শফীকে। বঙ্গবন্ধু আবৃত্তিমেলার আরো একটি বিশেষত্ব হলো, তিন দিনে বাংলাদেশ ও ভারতের ১০০ জন আবৃত্তিশিল্পী বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত কবিতা আবৃত্তি করেন।
বলা যায়, সাংগঠনিক আবৃত্তিচর্চার ইতিহাসে বহু ব্যতিক্রমী সূচনার সার্থক কাণ্ডারী শব্দনোঙর। শব্দনোঙর বেশি সংখ্যক আবৃত্তি অনুষ্ঠানের চেয়ে প্রতিটি অনুষ্ঠানের গুণগত মান বজায় রাখতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। বড়দের দলীয় প্রযোজনার মধ্যে ‘ছন্দে জাগুক আগামী প্রহর, শোনো আহ্বান, বৃষ্টি গাঁথা, কান্ডারী হুঁশিয়ার, তোরা সব জয়ধ্বনি কর, হাসিমুখে বাজাই বাঁশি, ভাষার লড়াই, ঝরুক পাতা পুরনো পাতা, এসো হে বৈশাখ, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে, প্রথম অতিথি, জনতার সংগ্রাম চলবেই, তুমি মুজিবর আত্মার স্বর, মুক্তির সুর, তাঁর জন্যে প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ছোটদের প্রযোজনাগুলোর মধ্যে ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, হই হই রই রই, আমাদের স্বাধীনতা, রাজা যায় রাজা আসে, একুশের ফুল, ভোর হলো, আমরা যদি না জাগি মা ইত্যাদি দর্শকনন্দিত প্রযোজনা। সংগঠনের সদস্যরা মঞ্চ ও টিভিতে একক ও দলীয় পরিবেশনায় অংশ নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। শ্রুতি নাটকের মধ্যে লাভ থেরাপি, হেয়ার এইড, পিতরি প্রীতিমাপন্নে, দূরভাষিনী, সুন্দর কথা, উচ্চারণ বিভ্রাট আবৃত্তিপ্রেমী শ্রোতাদের অকুণ্ঠ প্রশংসা অর্জন করেছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘শিক্ষার্থীকে বহুমাত্রিক প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে হবে’
পরবর্তী নিবন্ধসোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন