শনাক্ত ও হাসপাতালে নিতে দেরির কারণে মৃত্যু বাড়ছে ডেঙ্গুতে

জ্বরের প্রথম তিন দিনের মধ্যে ডেঙ্গু টেস্ট করা ।। রক্তের প্লাটিলেট এক লাখের নিচে নামলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ৮ নভেম্বর, ২০২২ at ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ

মধ্য আগস্টের পর থেকে বাড়তে থাকা ডেঙ্গুর প্রকোপ যেন কমছেইনা চট্টগ্রামে। বরঞ্চ এ রোগে আক্রান্তদের মাঝে মৃত্যুর হার যেন দিনদিন বাড়ছে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত মোট ১৯ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে চট্টগ্রামে। এর সিংহ ভাগ মৃত্যুই গত অক্টোবরে। নভেম্বরেও মৃত্যুর এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। চলতি মাসের প্রথম ৬ দিনে অন্তত ৪ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়।

জ্বরে ভুগলেও ডেঙ্গু শনাক্তে দেরি এবং রোগীকে হাসপাতালে আনতে বিলম্বের কারণেই আক্রান্তদের মাঝে মৃত্যুর হার বাড়ছে বলে মনে করেন চিকিৎসকরা।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাকিল ওয়ায়েজ বলছেন, হাসপাতালে আসা রোগীদের ক্ষেত্রে আমরা যেটি দেখছি, বেশ কিছুদিন জ্বরে ভুগলেও ডেঙ্গুসহ কোনো টেস্ট না করে রোগীকে বাসায় রাখা হচ্ছে। এরপর অবস্থা খুব খারাপ হলে তখন রোগীকে হাসপাতালে আনা হচ্ছে। বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে আমরা এরকম তথ্য পাচ্ছি।

শুধু দেরি করার কারণেই এবং শুরু থেকে যথাযথ চিকিৎসা না পাওয়ায় অনেক রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।

একই কথা বলছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরীও। তিনি আজাদীকে বলেন, অন্যান্য দেশেও ডেঙ্গুর প্রকোপ আছে। কিন্তু সেসব দেশে মৃত্যুর হার খুবই কম। আমাদের এখানে মানুষের অসচেতনতায় মৃত্যু বাড়ছে।

৪/৫ দিন জ্বরে ভুগলেও মানুষ ডেঙ্গু টেস্ট করায়না। ফলে অবস্থা খারাপ হলে তখন হাসপাতালে নেয়া হয়। অর্থাৎ হাসপাতালেও নেয়া হচ্ছে দেরিতে। আর এই বিলম্বের কারণেই অনেক রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।

চিকিৎসকরা বলছেন, তীব্র জ্বর (যা টানা ৪/৫ দিন অথবা একবার কমে আবারো আসতে পারে), বমি বমি ভাব, পেট ব্যথা, মাথা ব্যথা ও শরীরে বিভিন্ন জায়গায় লালচে দাগ বা র‌্যাশ দেখা দিতে পারে। এসবই ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ।

জ্বরের প্রথম তিন দিনের মধ্যে অবশ্যই ডেঙ্গু (এনএস-ওয়ান) টেস্ট করার পরামর্শ দিয়ে সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী ও চমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাকিল ওয়ায়েজ বলছেন, পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়লেও সাথে সাথে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন পড়েনা। তবে কিছু অ্যালার্মিং উপসর্গ দেখা দিলে রোগীকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। অ্যালার্মিং উপসর্গের মধ্যে রয়েছে- তীব্র জ্বরের সাথে পেট ব্যথা, বমি, রক্তচাপ কমে যাওয়া, শরীরে বিভিন্ন জায়গায় লালচে দাগ বা র‌্যাশ, প্রস্রাব-পায়খানায় বা অন্য কোনোভাবে রক্ত যাওয়া। এসব অ্যালার্মিং উপসর্গ থাকলে এবং রক্তের প্লাটিলেট এক লাখের নিচে নামলে রোগীকে অবশ্যই দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।

এদিকে, ডেঙ্গু আক্রান্তদের টানা ৫/৬ দিন তীব্র জ্বর থাকতে পারে জানিয়ে চমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আব্দুর সাত্তার বলেন,
৫/৬ দিন পর জ্বর নেমে যেতে পারে। তবে জ্বর নামলেও জ্বরের ৬ থেকে ১০ দিনের সময়কালটি রোগীর জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এসময় রক্তের প্লাটিলেট অতিমাত্রায় কমে যেতে পারে। ফলে এই সময়ে অবশ্যই বাড়তি সতর্কতা জরুরি। প্রয়োজনে রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে বলে জানান তিনি।

চমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আব্দুর রব মাসুম বলছেন, আক্রান্ত রোগীকে বেশি বেশি তরল জাতীয় (পানীয়) খাবার খাওয়াতে হবে। এটাই মূলত ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা। জ্বর থাকলে শুধু সাধারণ প্যারাসিটামল চলবে। আক্রান্ত রোগীর রক্ত (সিবিসি) পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়মিত রক্তের প্লাটিলেট ও কিছু ইনডিকেটর মনিটর করতে হবে। এটা খুবই জরুরি। রোগীকে এসময় তরল জাতীয় খাবার (জুস, ডাবের পানি, স্যালাইন, স্যুপ প্রভৃতি) বেশি বেশি খাওয়াতে হবে। পরিবারের কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এই চিকিৎসক।

সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গতকালের আগের ২৪ ঘন্টায়ও নতুন করে ৬৩ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে চট্টগ্রামে। আর শতাধিক রোগী বর্তমানে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। সবমিলিয়ে চলতি মৌসুমে (জানুয়ারি থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত) চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১২৮ জনে। আক্রান্তদের মাঝে মৃত্যু হয়েছে ১৯ জনের। হিসেবে ২০১৯ সালে ডেঙ্গু মহামারির সময়ের তুলনায় চলতি বছর আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেশি চট্টগ্রামে। ২০১৯ সালে মহানগরসহ চট্টগ্রাম জেলায় (চমেক হাসপাতালের তথ্যসহ) ২ হাজার ৫৪৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। মৃত্যু হয় অন্তত ৭ জনের।

এদিকে, আর সপ্তাহখানেক পর ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে আসতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেছেন সিভিল সার্জন।

সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে সদ্য শেষ হওয়া অক্টোবরে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংখ্যক আক্রান্ত হয়েছে চট্টগ্রামে। অক্টোবর মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮৬১ জনে। যা সেপ্টেম্বর মাসের তিনগুণ। সেপ্টেম্বরে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬০১ জন। আগস্টে ১১৪ জন এবং জুলাইয়ে ৬৪ জন আক্রান্ত হয়। এর আগে জানুয়ারিতে ৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪ জন, মার্চে ১ জন, এপ্রিলে ৩ জন, মে মাসে ০ জন এবং জুনে ১৯ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয় চট্টগ্রামে। আর চলতি নভেম্বরের প্রথম ৬ দিনে চার শতাধিক ডেঙ্গু রোগী শনাক্তের তথ্য দিয়েছে সিভিল সার্জন কার্যালয়। সবমিলিয়ে চলতি বছর (জানুয়ারি থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত) ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১২৮ জনে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত আরো একজনের মৃত্যু
পরবর্তী নিবন্ধসুদ হারের সীমা তুলে দেওয়ার ভাবনা