অবিভক্ত বাংলা বলুন, আর পূর্ববাংলা বলুন কিংবা ওপার বাংলা… এটুকু অনুভব করাই যায়, এই বাংলাদেশের ওপর আছে আপনার আত্মার অধিকার। তাই তো আপনি বলেন, ‘পা-ডোবানো অলস জল, এখন আমায় মনে পড়ে? কোথায় চলে গিয়েছিলাম ঝুরি-নামানো সন্ধ্যাবেলা? খুব মনে নেই আকাশ-বাতাস ঠিক কতটা বাংলাদেশের, কতটা তার মিথ্যে ছিল বুকের ভিতর বানিয়ে-তোলা; নীলনীলিমা ললাট এমন আজলকাজল অন্ধকারে, ঘনবিনুনি শূন্যতা তাও বৃক্ষ ইব চতুর্ধারে! কিন্তু কোথায় গিয়েছিলাম? মাঝি, আমার বাংলাদেশের ছলাৎছল শব্দ গেল অনেক দূরে মিলিয়ে, সেই শব্দকুহক, নৌকাকাঙাল, খোলা আজান বাংলাদেশের কিছুই হাতে তুলে দাওনি, বিদায় করে দিয়েছ, সেই স্মৃতি আমার শহর, আমার এলোমেলো হাতের খেলা, তোমায় আমি বুকের ভিতর নিইনি কেন রাত্রিবেলা?’ মানচিত্রের কাঁটাতার কেবল মানুষের দেহের প্রবেশাধিকার সংরক্ষণ করে। আত্মার অধিকার বোধহয় সংরক্ষণ করতে পারে না। হাতের কাছে পান না, কোলের কাছে পান না… কিন্তু প্রতিনিয়ত বুকের কাছে কুলকুল বয়ে যায় আপনার প্রিয় সন্ধ্যানদী। আত্মার মেলবন্ধনের অপূর্ব স্মৃতি আপনার কবিতায় ঘূর্ণিজলের মতো ফিরে ফিরে এসেছে। এই যে আত্মার টান, এই যে আন্তরিকতা… সে-তো বৃথা যেতে পারে না। এর নিশ্চয়ই একটা মূল্যহীন মূল্য আছে, যে অসীম সাংস্কৃতিক ধন-ঐশ্বর্যের গর্বিত উত্তরাধিকার আমরা সমানভাবে বয়ে চলেছি।
১৯৪৭ সাল…বিভিন্ন ধর্মকে মনের ভেতর থেকে, ঘরের ভেতর থেকে টেনে হিঁচড়ে দেশের সীমানায় বের করে আনা হলো। ক্ষত কি কেবল জমিনে গভীর হলো? রক্ত ঝরলো অঝর ধারায়, শেকড় থেকে শেকড়ে। মানুষ আর শুধু মানুষ রইলো না, হয়ে গেল শুধুই হিন্দু কিংবা মুসলিম। শুরু হয়েছিল স্বপ্নভঙ্গ আর নতুন স্বপ্নের এক বিচিত্র টানাপোড়েন। দেশভাগ হলো, ভাগ হলো মানচিত্র, মানুষও ভাগ হলো। শুধু কিছু দুঃখস্মৃতিকাতর হৃদয়ে ভালবাসা রয়ে গেল পূর্ণপ্রাণ। আপনি গিয়ে থিতু হলেন ওপার বাংলায়, কলকাতায়। বাস স্থির হলো, শরীর স্থির হলো যতটা, কবির মন কি স্থিরতা পেল সেই শহরে ততটা! ‘এই শহরটা ঘিরে আমার খুব একটা ভালোবাসা আছে। কিন্তু অন্য একটা দিকে এটাকে কিছুতে আপন বলতে পারি না, ভাবতে পারি না। এ-কলকাতাটা আমার কলকাতা, আবার আমার নয়।’ এ শহরের গড়নে, শতবর্ষের ইতিহাসের মধ্যে আপনি নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন, কিন্তু যখন মানুষজনের মধ্যে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন, নিজেকে কোথাও যেন ‘আউটসাইডার’ বোধ করেছেন। এরা কারা এলো! এই ‘এরা’ ধ্বনিটা প্রতিধ্বনিত হয়ে বারবার কবিহৃদয়কে বিক্ষুব্ধ করেছিল। এই যে আলাদা করে চিহ্নিত করা, এটাই নিজেকে ‘বাইরের থেকে আসা লোক’ বোধটুকু দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল। বোধকরি তখনই আপনি লিখেছিলেন, “ছোট হয়ে নেমে পড়ুন মশাই সরু হয়ে নেমে পড়ুন মশাই, চোখ নেই? চোখে দেখতে পান না? সরু হয়ে যান, ছোট হয়ে যান…।” একজন সদ্য বাস্তুহীন মানুষের প্রতি প্রত্যাখ্যান কী প্রবলভাবে মূর্ত হয়েছিল প্রতি অক্ষরে!
১৯৫৪ সাল… উদ্বাস্তু মানুষের কোনো দেশ নেই ভাবা এই মানুষটির ধীরে ধীরে দেশ, সমাজ আর মার্ক্সবাদ বিষয়ে গভীর একটা বোধ জন্ম নিতে শুরু করেছিল। না, কোনো দলের হয়ে যাননি আপনি। না, শেষপর্যন্ত না। তাই দীর্ঘসময়কাল ধরে নিজের মতকে নিজের মতো করে অক্ষরে সাজাতে পেরেছিলেন, উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন। রাজনীতিতে না জড়িয়েই কী দুর্দান্ত স্পর্ধায় রাজার অন্যায়-অনাচারের নীতিকে বিঁধে ফেললেন কতশত কবিতায়! “শব্দবাহুল্যের বাইরে দাঁড়িয়ে, ভুল আস্ফালনের বাইরে দাঁড়িয়ে সত্যিই যদি নিজেকে, নিজের ভিতর এবং বাহিরকে, আগ্নেয় জীবনযাপনের বিভীষিকার সামনে খুলে দিতে পারেন কবি, সেই হবে আজ তার অস্তিত্বের পরম যোগ্যতা, তার কবিতা।” এই বিশ্বাসে বলিয়ান হয়েই কবি কলম ধরেন সত্যের পক্ষে, ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে। যখনই প্রয়োজন পড়েছে আপনি ঝলসে উঠেছেন, শান্ত ভাষায় শান্তির আবরণে, সামাজিক সঙ্কটে, রাজনৈতিক অস্থিরতায় কবি ব্যক্ত করেছেন স্পষ্ট প্রতিক্রিয়া। কবির সেই অক্ষরের নৈঃশব্দ্য কেমন সশব্দ প্রতিবাদ হয়ে ঝরেছে প্রতিটি আন্দোলনের মূলমন্ত্র হয়ে। ‘আজ অভিশাপ দিই, বলি, ভুল নেমে যা নেমে যা/ আবার প্রথম থেকে চাই/ দাঁড়াবার মতো চাই যেভাবে দাঁড়ায় মানুষেরা।’ আমাদের সহস্রজনের শত প্রতিবাদের চাইতেও এই লেখা অনেক বেশি শক্তি ধারণ করেছে। যে-শক্তির ওপর ভর করে দাঁড়াতে চেয়েছে সকলে। এ-আমির আবরণে মোড়ানো এক সর্বজনমান্য নাম হয়ে রইলেন আপনি।
কবিতা লিখলে কবি হওয়া যায়। সহজ। তবে কবি ‘হয়ে-থাকা’টা কঠিনই বটে। ‘হয়ে-ওঠা’ আর ‘হয়ে-থাকা’র মধ্যে বিপুল দূরত্ব। ‘হয়ে‘ থাকতে গেলে সমাজের প্রতি কিছু দায়বদ্ধতা লালন করতে হয়, পালন করতে হয়। রাষ্ট্রের দেয়া ললিপপ মুখে গুঁজে থাকার এই অক্ষমতার কালে আপনি ঋজু হয়েই দাঁড়িয়ে ছিলেন, শেষদিন পর্যন্ত। রাষ্ট্রতো কোন্ ছাড়! নিজের সঙ্গে নিজের কেনাবেচার বোঝাপড়াটাও কী স্পষ্ট! কী চমৎকার! সেখানেও এক নির্ভুল ছন্দ! কোথাও কোনো ধোঁয়াশা নেই।
প্রিয় কবি, প্রিয় কবি বলে হাঁকডাক, হাহাকার করাই যায়! প্রিয় বলে যখন মানছি, প্রিয়’র অন্তর্গত কিছু বোধ, কিছু ধ্যান আমরা কি অন্তরআত্মায় ধারণ করতে চেয়েছি কখনো! একটু কিছু কি শেখা যায় ওঁর কাছ থেকে? শিখতে চেয়েছি কখনো? বিবেকের পাঠ! শিরদাঁড়া সোজা করে পিঠ-ঠেকে যাওয়া দেয়ালে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পাঠ। একজন কবি যে সমাজের বিবেক, তা প্রমাণ করার পাঠ। প্রগলভার ভার এড়িয়ে পরিমিতির প্রতীক হবার পাঠ। উচ্চকিত না হয়েও সরব থাকার পাঠ। শান্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে ফ্যাসিবাদকে বকতে পারার পাঠ।
আপনাকে আমার প্রণাম, শঙ্খ ঘোষ। রয়ে যান আপনার কবিতা আর স্বাদু গদ্যে; যখন ‘আজ আর কেউ নেই, মাঝে মাঝে কার কাছে যাব।’…এই ভাবনা গ্রাস করতে চাইবে, তখন ওদের কাছেই যাব আমি আর আমরা।