লেয়ার লেভিন ও মুক্তির গান

রেজাউল করিম | বুধবার , ২২ ডিসেম্বর, ২০২১ at ১০:৩৮ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী, একই সাথে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছে। বাংলদেশের স্বাধীনতা একদিনে আসেনি। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের জন্য বাঙালিকে প্রস্তুত করতে সময় লেগে যায় ২৩ বছর। এক সাগর রক্ত ও অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে আসে স্বাধীনতা। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে আরো বেগবান করতে কিছু বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে অন্যতম লেয়ার লেভিন। যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়কার চিত্রগ্রাহক এবং আমাদের পরম বন্ধু। লেভিন একাত্তরে এসেছিলেন বাংলাদেশে, নিজের জীবনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে। ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ নামক একটি দলের সঙ্গে সারাদেশে ঘুরে-ঘুরে ভিডিও করেছেন। তাঁর দৃশ্যপটে উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধের বিরল সব চিত্র।
শিল্পীদের সঙ্গে থেকে লেভিন সেই সময় অনেক ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করবেন। অর্থের অভাবে সেই ইচ্ছে পূরণ করতে পারেননি। লেভিন অত্যন্ত যত্ন সহকারে সেগুলো তুলে রেখেছিলেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। দীর্ঘ বিশ বছর পর তাঁর অপেক্ষার অবসান ঘটে। বাংলাদেশি চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ নিউইয়র্কে তাকে খুঁজে বের করেন। মাহমুদুর রহমান বেণু খুঁজে পেতে সাহায্য করেন। মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার প্রধান ছিলেন বেণু। যিনি ঐ সময়ে ধারণ করা চিত্রের মূল ব্যক্তি। তিনি আবার তারেক মাসুদের চাচাতো ভাই।
চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ লিখেছেন, ‘শুধু লেয়ার লেভিনের ফুটেজ নয়, মুক্তির গানের জন্য আমরা যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, কানাডা, ফ্রান্স, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর ফুটেজ সংগ্রহ করেছি। সেগুলো দেখে মনে হয়েছে লেয়ারের কাজের সামনে লাখো ঘণ্টার ফুটেজও কিছু না। তাঁর ফুটেজ ও সহযোগিতায় ‘মুক্তির গান’ এর অস্থিমজ্জা দাঁড়িয়েছে।’
লেভিন মার্কিন চলচ্চিত্র পরিচালক, আলোকচিত্র শিল্পী ও মার্কিন টিভি সাংবাদিক। তিনি ১৯৭০ সালে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ছুটে এসেছিলেন। তখন তিনি ঘূর্ণি-উপদ্রুত মানুষকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন যা দুর্গতদের সাহায্যে তহবিল সংগ্রহে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। এরপর ১৯৭১ সালে এদেশের মানুষের ওপর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অত্যাচার নির্যাতনের বার্তায় ব্যথিত হয়ে পুনরায় বাংলাদেশে আসেন। মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত এবং ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী লাখ লাখ শরণার্থীর দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে তিনি প্রামাণ্যচিত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। লেভিন প্রায় ছয় সপ্তাহ পশ্চিম বাংলায় থেকে বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ও যুদ্ধফ্রন্টের ছবি তোলেন। পরে ২২ ঘণ্টার ফুটেজ নিয়ে তিনি ‘জয় বাংলা’ নামে ৭২ মিনিটের একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। কিন্তু কোনো স্পন্সর না পাওয়ায় ছবিটি পরিত্যক্ত হয়। দুই দশকের বেশি সময়ের পর বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও তাঁর স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ লেভিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর তোলা ফুটেজগুলো সংগ্রহ করেন। তাঁরা লেভিনের ফুটেজকে নবরূপায়ণ দেন ‘মুক্তির গান’ ছবিতে। লেভিনের এই প্রয়াসে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের তাৎপর্যপূর্ণ দিক দালিলিকভাবে ফুটে ওঠেছে। লেভিনের ফুটেজ আর তারেক-ক্যাথরিন মাসুদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফসল ‘মুক্তির গান।’ এই ছবির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের আরেক অধ্যায় সম্পর্কে জানার সুযোগ ঘটে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবীর মুক্তিযোদ্ধারা জাতির সূর্য সন্তান
পরবর্তী নিবন্ধপ্রিয় মাতৃভূমি