১৮৭০-এর দিকের বৃটিশ এম.পি. স্যামুয়েল প্লিমসল ছিলেন মেরিনারদের জন্য অতি হিতৈষী এবং দরদীপ্রাণ ব্যক্তিত্ব। একমাত্র ওনার উদ্যোগ ও অক্লান্ত প্রচেষ্টায় শত-শত জাহাজ দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে; সেই সাথে শত-শত নাবিকের জীবনও বেঁচেছে। নিজে মেরিনার না হয়েও, তাদের হয়ে পার্লামেন্টে লড়ে গেছেন নিরাপদ জাহাজের জন্যে; এবং সফলভাবে বিল পাশ করিয়েছিলেন। শুধু বৃটিশ পার্লামেন্টে বিল পাশ নয়, ওনার কারণেই আন্তর্জাতিক আইন প্রবর্তন হয়েছে। ওনার অবদান হলো- উনি জাহাজে পানির দাগ কেটেছিলেন। সেজন্যই সেই দাগের নাম আজও রয়ে গেছে প্লিমসল লাইন (Plimsoll Line) হিসাবে। যদিও, এখন অফিসিয়ালি বলে ইন্টারন্যাশানাল লোড লাইন (International load line)।
গতসপ্তাহে লিখেছিলাম, মেরিন-গ্রোথ ঠেকানোর জন্যে অধিকাংশ জাহাজের খোলেই পানির তলায় থাকে এন্টি-ফাউলিং কপার-বেইস্ড্ লাল বা অন্যরঙ। আর প্রতিকূল পরিবেশে মরিচা থেকে রক্ষার জন্যে, জাহাজের বডির পানির উপরের অংশে থাকে rust-preventive পেইন্ট। কিন্তু, তাহলে তো একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করতে হয়- দুই রঙের মাঝের বিভাজনরেখা। সেইটা কীভাবে এলো? উত্তর নিশ্চয়ই বুঝছেন প্লিমসল-লাইন; কিন্তু সেটা কোথায় দিবো? কীভাবে নির্ণয় করবো? উত্তর আছে ‘সমগ্র বাংলাদেশ ৫ টন’ কথাটার মধ্যে।
অন্যভাবে বলি, এই প্লিমসল-লাইন দিয়েই জাহাজের ধারণক্ষমতা প্রদর্শন করা হয়। জাহাজে যত মাল বোঝাই করা হবে, সেটা ততই পানির ভিতরে ডুবতে থাকবে। কিন্তু তাই বলে তো আমরা মালের পর মাল বোঝাই করে যেতেই পারি না। একটা নিরাপদ লিমিট থাকা দরকার। অতি সহজভাবে বলি- দুর্গম সমুদ্রে, ঝড়-ঝাপ্টার মাঝে একটা জাহাজ কতটুকু মাল নিরাপদে নিয়ে ভেসে থাকবে, সেটুকু বোঝাই করার পরে জাহাজটার কতটুকু অংশ পানির তলায় ডুববে- সেখানেই প্লিমসল লাইন দেওয়া হয়। এর বেশী মাল তুললে, জাহাজ ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই হিসাব-নিকাশ জাহাজের জন্মদিনের সময়ই করা হয়ে থাকে; এবং শিপ-বিল্ডিংইয়ার্ড সেই বরাবর জাহাজের খোলে (hull)-এ একটা মার্কিং দিয়ে দেয়। সেটা শুধু পেইন্ট করে দিলেই চলবে না – পার্মানেন্ট করে খোদাই করা থাকে, যাতে পেইন্ট ঘষে উঠে গেলেও অসুবিধা না হয়।
এই প্লিমসল লাইন, নিজে নিজে খুশীমত এঁকে দিলেই হলো না- আপনার হিসাবে ভুলও থাকতে পারে, বা কেউ হয়তো জালিয়াতিও করতে পারে। সেজন্যে, সঠিক হিসাব-নিকাশ করার পরে সেটা আন্তর্জাতিক ক্লাসিফিকেশান সোসাইটি থেকে যাঁচাই করিয়ে, সার্টিফাই করে নিতে হয়- LR (Lloyd’s Register), ABS (American Buereau of Shipping), BV (Bureau Veritas); DNV (Det Norske Veritas) ইত্যাদি হলো ক্লাসিফিকেশান সোসাইটির উদাহরণ।
কোনো জাহাজের খুবই কাছে যাওয়ার যদি সুযোগ হয়, তাহলে খেয়াল করে দেখবেন জাহাজের গায়ে মাঝ বরাবর, পানির কাছে খোলের উপরে একটা গোল বৃত্ত আঁকা এবং এর পাশে কয়েকটা দাগ কাটা (দেখতে কিছুটা সিঁড়ির মত)। সেইসাথে থাকে কিছু ইংরেজি অক্ষর। এই চিহ্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ; এবং এটাকে মেনে চলা আরো গুরুত্বের- জানমালের নিরাপত্তা জড়িত। বাংলাদেশে নৌপথে লঞ্চ-স্টীমার ইত্যাদি ডুবার এবং অগনিত প্রানহানীর একটা প্রধান কারণ ক্যাপাসিটির অতিরিক্ত মাল (বা যাত্রী) বোঝাই। আন্তর্জাতিক সমুদ্রগামী জাহাজে সেরকম করা সম্ভব নয়- করলে ক্যাপ্টেনসহ সকলের বিশাল পেনাল্টি হবে- চাকরীচ্যুত, জেল-জরিমানা, লাইসেন্স/সার্টিফিকেট বাতিল – সবই হতে পারে। তাই বলে সমুদ্রগামী জাহাজ ডুবে না? হ্যা, মাঝেমধ্যে ডুবে; কিন্তু সেটা অতিরিক্ত যাত্রী বা মাল বোঝাইয়ের গাফিলতির জন্যে নয়। মানুষ তো আর সৃষ্টিকর্তার মত পারফেক্ট নয়; আর মহাসমুদ্র যে কীরকম ভয়াল হতে পারে, সেটা সব মেরিনারই জানে। কিন্তু প্লিমসল লাইন মেনে চলার কারণে অনেকগুণে এক্সিডেন্ট কমে গেছে।
এবারে প্যাঁচ কষাই – প্লিমসল লাইন কিন্তু স্থানকালপাত্র ভেদে পরিবর্তনশীল। উষ্ণ পানির ঘনত্ব কম, আবার অতি ঠান্ডা পানি বেশ ঘন। মিঠা পানির ঘনত্ব কম, লোনা পানি বেশী ঘন। ট্রপিকাল আবহাওয়া, শীত ও গ্রীষ্মকালে ভিন্ন; উত্তর আটলান্টিকের পানি আবার অন্যরকম। তাপমাত্রা ও লবণাক্ততার ভেদে সমুদ্রের পানির ঘনত্ব বদলায়, আর এর ফলে জাহাজের প্লবতা (buyouncy) বাড়ে কমে, যার মানে সেই যে মাল বহনের লোডলাইন, সেটারও হেরফের হয়। একটু আগে যে, বৃত্তের পাশে দাগ ও অক্ষরগুলোর কথা বলেছিলাম সেগুলো দিয়ে সেটাই দেখানো হয়। প্লিমসল লাইন ও সামার লোডলাইন একই। এর পাশে, সিঁড়ির মত করে স্পষ্ট করে যেগুলো দাগানো থাকে, তাদের মানে হলোঃ T – Tropical, TF – Tropical Freshwater, S – Summer, W – Winter, WNA – Winter North Atlantic, ইত্যাদি। মোটামুটি সব জাহাজেই এরকম দেখবেন; কিন্তু কোনো কোনো জাহাজে আরো একটা অক্ষর যোগ করে, T; আর তখন এই টি-অক্ষরের মানে দাঁড়ায় টিম্বার বা কাঠ। কাঠবহনকারি জাহাজগুলোর লোডলাইন একটু ভিন্ন থাকে অন্যান্য সব জাহাজ থেকে।
আরো একটা জিনিস আপনাদের চোখে পড়তে পারে, জাহাজের একদম সামনে (forward ev bow); এবং একদম পিছে, (stern ev aft) – এই দুই জায়গায়, দাগ কেটে কেটে তলা থেকে উপর পর্যন্ত সংখ্যা লেখা আছে। সেটাকে আমরা ড্রাফট (draft) বলি, মানে – জাহাজ পানির ভিতরে কতটুকু ডুবে থাকলো, তার পরিমাপ। মাল বোঝাই বা খালাসের সময়ে, কিছুক্ষণ পরপরই এই ড্রাফ্ট্ রেকর্ড করা হয়, যাতে কোনমতেই অতিরিক্ত মাল বোঝাই না হয়ে যায়, বা জাহাজ তার স্ট্যাবিলিটি না হারায়। জাহাজ কতটুকু ডুবলো সেটাকে ড্রাফ্ট্ বলে; আর পানির উপরে যেই অংশটুকু থাকে, সেটাকে ফ্রীবোর্ড (freeboard) বলে।
জাহাজের সামনে-পিছের দুইদিকের ড্রাফ্ট্ সমান হলে, জাহাজ একদম পারফেক্টলি সমান আছে, আমরা বলি even-keel; জাহাজের দুইদিকের খোল নীচে নেমে, জাহাজের সবচেয়ে তলায় যেই জায়গায় জোড়া লেগেছে, সেই জায়গা খুবই মজবুত রাখতে হয়। কাঠের জাহাজগুলোতে সেখানে সবচেয়ে শক্ত ও সোজা কাঠের গুড়ি ব্যবহার করতো। সেটাকেই কীল বলে। Even-keel ঠিক আছে, তবে ড্রাফ্ট্ পিছের দিকে বেশী থাকাটাই ভালো, কারণ পিছনে থাকে জাহাজের প্রপেলার। সেটা সবসময়ই যেন পানির তলায় থাকে সেই চেষ্টা করা হয়, তানাহলে প্রপেলার পানির উপরে থাকলে, জাহাজের মেইন ইঞ্জিন যেই পরিমাণ শক্তি খরচ করে চলতে চাইবে, জাহাজের স্পিড কিন্তু তার থেকে অনেক কম হবে। বাতাসে প্রপেলারের এফিসিয়েন্সি-লসের কারণে। সেজন্য আমরা পারতপক্ষে চাই না জাহাজ সামনের দিকে ঝুঁকে থাকুক, এটাকে negative trim বলে। মাল খালাস বা বোঝাইয়ের সময়ে এগুলোর দিকে লক্ষ্য রাখতে হয় সবসময়ই। আর এটা তো নিশ্চয়ই সবাই বুঝেন যে, জাহাজ বোঝাইয়ের সময়ে ডানে-বামে কাত করেও বোঝাই করা যাবে না। এগুলো সবই সমুদ্রের মাঝে জাহাজের নিরাপত্তার ব্যাপার। একটু হেরফের হলেই জাহাজসহ নাবিকদের সকলের জান-প্রাণ নিয়ে টানাটানি পড়বে।
জাহাজের নটিক্যাল ডিপার্টমেন্ট এসমস্ত কাজগুলো করে থাকে; বিশেষ করে চীফ-অফিসার কার্গো লোডিং-এর ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত। আগেকার দিনে তো কাগজ-কলম-ক্যালকুলেটর দিয়ে মাল কোথায় কোনটা বোঝাই হবে, তার হিসাব করতো, স্ট্যাবিলিটি ক্যালকুলেশান করে। আজকাল সবই কম্পিউটারে হয়ে যায়। কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন জাগে- দেশের লঞ্চ ও অন্যান্য নৌযানে কী এই সিস্টেম মেনে চলা হয়? তারা কি জানে যে, তাদের লোভের কারণে কতশত মানুষ জীবন হারায়? বিশেষ করে ঈদের সময়ে। আর আমাদের মত যাত্রীরাও কী জানে- ঈদ করতে বাড়িত যাবো বলে কতবড় ঝুঁকি নেই আমরা? এর কী কোনো প্রতিকার আছে? কবে আমরা সকলে সচেতন হবো? স্যামুয়েল প্লিমসল কিন্তু ঠিক এই একই কারণেই ১৮০০ সালের দিকে লড়েছিলেন। আমাদের কী কেউ নেই? না আমরা এখনো সেই ১৮০০ সালেই পড়ে আছি? আমার একটা অনুরোধ কারো যদি কোনো বিষয়ে কোনো কৌতুহল থাকে, তাহলে আমাকে refayet@yahoo.com ই-মেইলে যোগাযোগ করতে পারেন। টলিডো, ওহাইও, ২০২২