টাইগারপাস থেকে সিআরবিমুখী পাহাড়ি রাস্তাটির মাঝের ঢালে এলিভিটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নির্মাণ করতে জমি ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে রেলওয়ের কাছে এবং পাহাড়ের ঢালে থাকা ৪৪টি গাছ কাটার অনুমতি চেয়ে বন বিভাগের কাছে আবেদনও করা হয়েছে। ওই আবেদন অনুমোদন পেলে সেখানে তিন ডজনের বেশি শতবর্ষী গাছ কাটা পড়বে। সড়কটি হারাবে নান্দনিকতা। সে কারণে পরিবেশবাদী ও নাগরিক অধিকার কর্মীরা সিডিএর এই উদ্যোগকে দায়িত্বজ্ঞানহীন বলছেন। র্যাম্পটি নির্মাণের জন্য বিকল্প খুঁজে বের করার তাগিদ দিচ্ছেন। খবর বিডিনিউজের।
রেল কী বলছে : রেলওয়েকে দেওয়া চিঠিতে ‘প্রকল্পের অনুমোদিত এলাইনমেন্টের মধ্যে’ নগরীর আগ্রাবাদ থেকে বিমানবন্দরমুখী গাড়ি ওঠার র্যাম্প নির্মাণের জন্য শেখ মুজিব সড়ক সংলগ্ন ডেবারপাড় এলাকায় ২১ দশমিক ৭৭ শতক জমি ব্যবহারের অনুমতি চেয়েছে সিডিএ। একই চিঠিতে পলোগ্রাউন্ড বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে থেকে টাইগারপাস হয়ে দেওয়ানহাটমুখী র্যাম্প নির্মাণের জন্য ১৪ শতক জমি ব্যবহারে অনুমতি চাওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান ভূ–সম্পত্তি কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী বলেন, সিডিএ আমাদের কাছে জমি ব্যবহারের অনুমতি চেয়েছে। এ সংক্রান্ত পূর্ব রেলের ডিআরএমের নেতৃত্বে আমাদের সাত সদস্যের একটি বিভাগীয় কমিটি আছে। নিয়ম অনুসারে, শুরুতে বিভাগীয় কমিটি জমিটি পরিদর্শন করবে। সেখানে কি পরিমাণ জমি আছে, কত গাছ আছে, গাছ কাটা হবে কিনা, সব বিষয় যাচাই করে বিভাগীয় কমিটি প্রতিবেদন দেবে। এরপর এখানকার প্রক্রিয়া শেষে অনুমোদনের জন্য সদর দপ্তরে যাবে। এটা হলো প্রক্রিয়া।
চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এই সড়কে গাছ কেটে র্যাম্প নির্মাণে অনুমোদন দেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে সুজন চৌধুরী বলেন, এটা সরকারি অগ্রাধিকার প্রকল্প। বিভাগীয় কমিটির প্রতিবেদনের পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।
তিনি বলেন, দেওয়ানহাট রেল সেতুর উপর দিয়ে এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়ে নেয়ার সময় রেলওয়ের ৭০ শতক জমি ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছিল সিডিএ। তখন এই র্যাম্পের জমির জন্য আবেদন করা হয়নি। এ আবেদনটি কয়েকদিন আগে করা হয়েছে।
বন বিভাগ যা বলছে : জমি ব্যবহারে রেলের অনুমতি এখনো না মিললেও বন বিভাগের কাছে গাছ কাটার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে সিডিএ। পাশাপাশি কোন গাছগুলো কাটা হবে তা ‘মার্কিং’ করার কাজও শেষ হয়েছে।
চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের শহর রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আব্দুল খালেক বলেন, সিডিএ আমাদের কাছে একটি আবেদন করেছে। আবেদনের সাথে এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়ে প্রকল্পটির সরকারি অনুমোদনের কাগজপত্রও দিয়েছে। ৪৪টির মতো গাছের উল্লেখ করা হয়েছে আবেদনে। আমরা ইনকোয়ারি করেছি। কেউ আবেদন করলে আমরা পরিদর্শনের মাধ্যমে গাছের তালিকা করে কাঠের পরিমাপ ও মূল্য নির্ধারণ করি। আমরা এখনো প্রতিবেদন দিইনি। এখন আমি অফিসের বাইরে আছি তাই বিস্তারিত বলতে পারছি না।
গাছ কাটার অনুমতি দেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে রেঞ্জ কর্মকর্তা বলেন, গাছের মালিক হচ্ছে রেলওয়ে। সিডিএ রেলওয়ের কাছ থেকে অনুমতি নেবে। আমরা দেখব রেলওয়েকে তারা গাছের মূল্য পরিশোধ করেছে কিনা।
সিডিএর গাছ কাটার উদ্যোগের বিষয়ে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের মেট্রো অঞ্চলের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস বলেন, সিডিএর প্রকল্পে কী আছে, তা আমরা জানি না। আমাদের কেউ এ বিষয়ে কিছু জানায়নি। রেলের জমি হয়ে থাকলে তারা কি সিডিএকে গাছ কাটার অনুমতি দিয়েছে? কেউ অনুমতি দিয়েছে কিনা সে বিষয়েও আমাদের জানা নেই।
আপত্তি পরিবেশবাদীদের : এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়ের র্যাম্পটি পলোগ্রাউন্ড মাঠ সংলগ্ন যে অংশ থেকে শুরু হবে তার পাশেই চট্টগ্রামের ‘ফুসফুস’ খ্যাত সিআরবির পাহাড়। ২০২১ সালের জুলাই মাসে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সিআরবিতে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য জমি বুঝিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলে শুরু হয় আন্দোলন ও প্রতিবাদ। সেই আন্দোলন হয় নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রামের উদ্যোগে। টানা ১৫ মাস ধরে সেই আন্দোলন চলার পর সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাতিলের ঘোষণা আসে।
নাগরিক সমাজ চট্টগ্রামের যুগ্ম মহাসচিব সাংবাদিক মহসিন কাজী বলেন, যেখানে র্যাম্প নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে সেখানে শতবর্ষী বেশ কিছু গাছ আছে। র্যাম্প হলে সেই গাছগুলো কাটা পড়বে। নান্দনিক একটি সড়ক, র্যাম্প নির্মাণের জন্য সিডিএকে অবশ্যই বিকল্প ভাবতে হবে। চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধংসের কোনো অপচেষ্টা এই শহরের মানুষ মেনে নেবে না। প্রয়োজনে চট্টগ্রামের সব শ্রেণিপেশার মানুষকে নিয়ে আমরা আন্দোলনের ডাক দেব।
পরিবেশবাদী সংগঠন পিপল’স ভয়েসের সভাপতি শরীফ চৌহান বলেন, কোনো প্রকল্প গ্রহণের সময় শহরের প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েই তা করতে হয়। এটা সারা পৃথিবীতে অনুশীলন করা হয়। সিডিএর কর্তাব্যক্তিরা সকলেই চট্টগ্রামের মানুষ। তারা তো না জানার কথা নয় এই শহরে কোথায় কী আছে। এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন পদক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়।
তিনি বলেন, পাহাড়ি ঢালের উপরে ও নিচে এ রকম আইকনিক সড়ক চট্টগ্রামে এই একটিই আছে। সড়কের মাঝের অংশের গাছ কেটে র্যাম্প নামালে রাস্তাটির সৌন্দর্য আর থাকবে না। চট্টগ্রামের জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদরা চেষ্টা করলে এই সড়কটি রক্ষা করা সম্ভব। আশা করি তারা সচেষ্ট হবেন। সিডিএর কাছে অবিলম্বে র্যাম্পের নকশা পরিবর্তনের দাবি জানাচ্ছি। অন্যথায় আমরা আন্দোলনের পথে যাব।