রেললাইনে প্রাণ গেল ১১ জনের

আজাদী প্রতিবেদন ও মীরসরাই প্রতিনিধি | শনিবার , ৩০ জুলাই, ২০২২ at ৫:১৭ পূর্বাহ্ণ

শুক্রবার দুপুর দেড়টার দিকে মীরসরাই উপজেলার খৈয়াছড়া ঝর্ণা দেখে ফিরছিলেন হাটহাজারীর আমানবাজার এলাকা থেকে আসা ১৮ জনের ছাত্র-শিক্ষকের একটি দল। তাদের বহনকারী হাইস মাইক্রোবাসটি খৈয়াছড়া ঝর্ণা সড়কের রেলগেট পার হওয়ার সময় ট্রেনের ধাক্কায় দুমড়ে মুচড়ে গিয়ে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় ১১ তাজা প্রাণ। আন্তঃনগর মহানগর প্রভাতি ট্রেনটি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ফিরছিল। মাইক্রোটি ট্রেনের ইঞ্জিনে আটকে গিয়ে প্রায় পৌনে এক কিলোমিটার দূরে গিয়ে থামে। এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় উক্ত ঘটনায় অবহেলার দায়ে গেটম্যান সাদ্দাম হোসেনকে আটক করেছে জিআরপি থানা পুলিশ। মীরসরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কবীর হোসেন জানান, মাইক্রোবাসে ১৮ জন যাত্রী ছিলেন। এর মধ্যে ট্রেনের ধাক্কায় ১১ যাত্রী ঘটনাস্থলেই নিহত হন। আহত হয়েছেন আরো ৭ জন। তাদের মধ্যে ৬ জনকে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। চিকিৎসক জানিয়েছেন, এর মধ্যে ৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
শুক্রবার রাতে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহীদুল আলম বলেন, আর এন্ড জে কোচিং সেন্টারের শিক্ষক ও ছাত্ররা খৈয়াছড়া ঘুরতে গিয়েছিলেন। গাড়িতে কোচিং সেন্টারের ৪ জন শিক্ষক, ১২ জন শিক্ষার্থী ও চালক-হেলপার মিলে মোট ১৮ জন যাত্রী ছিলেন। দুর্ঘটনায় নিহত-আহতদের পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। নিহতরা হলেন, উপজেলার আজিম সাব রেজিস্ট্রার বাড়ির হাজী মো. ইউসুফের ছেলে মাইক্রোবাস চালক গোলাম মোস্তফা নিরু (২৬), চিকনদন্ডী ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মো. ইলিয়াছ ভুট্টোর ছেলে মোহাম্মদ হাসান (১৭), একই ইউনিয়নের খোন্দকার পাড়ার আবদুল হামিদের ছেলে জিয়াউল হক সজীব (২২), ৮ নম্বর ওয়ার্ডের আজিজ মেম্বার বাড়ির জানে আলমের ছেলে ওয়াহিদুল আলম জিসান (২৩), মজিদ আব্বাস চৌধুরী বাড়ির বাদশা চৌধুরীর ছেলে শিক্ষক রিদুয়ান চৌধুরী (২২), পারভেজের ছেলে সাগর (১৭) ও একই এলাকার আবদুল ওয়াদুদ মাস্টার বাড়ির আবদুল মাবুদের ছেলে ইকবাল হোসেন মারুফ (১৭), ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মোজাফফর আহমেদের ছেলে মোসহাব আহমেদ হিশাম (১৬), আব্দুল আজিজ বাড়ির মৃত পারভেজের ছেলে তাসমির হাসান (১৭), মনসুর আলমের ছেলে মো. মাহিম (১৭), ২ নম্বর ওয়ার্ডের আবু মুসা খানের বাড়ির মোতাহের হোসেনের ছেলে মোস্তফা মাসুদ রাকিব (১৯)। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন আহতরা হলেন তৌকিদ বিন শাওন (২০), তছমির পাভেল (১৬), মো. মাহিম (১৮), সৈকত (১৮), তানভির হাসান হৃদয় (১৮), ইমন (১৯)।
জানা গেছে, দুর্ঘটনা কবলিত নিহত-আহত সকলেই হাটহাজারী উপজেলার জুগিরহাট আর এন্ড জে কোচিং সেন্টারের ছাত্র ও শিক্ষক। নিহত এসএসসি পরীক্ষার্থী হিশামের বন্ধু সাজিদ বলেন, আমারও ওদের সঙ্গে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একটি ফুটবল ম্যাচ থাকায় আর যাওয়া হয়নি। আমি আমার বন্ধুদের হারিয়ে ফেললাম। ওদের আর কোনোদিন দেখতে পাব না বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন সাজিদ।
সরেজমিনে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, দুপুর দেড়টার দিকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছিল আন্তঃনগর মহানগর প্রভাতি। এসময় খৈয়াছড়া রেলগেট দিয়ে একটি মাইক্রোবাস (চট্টমেট্রো চ-৫১-২৩৫০) দ্রুতগামী এই ট্রেনটির সামনে পড়লে মাইক্রোবাসটিকে রেলের ইঞ্জিনের মুখে করে প্রায় পৌনে এক কিলোমিটার টেনে নিয়ে যায়। কিন্তু ততক্ষণে মাইক্রোতে থাকা ১৮ জনের মধ্যে ১১ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এলাকাবাসী, ফায়ার সার্ভিস, মীরসরাই থানা পুলিশ, জিআরপি পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে নিহতদের মৃতদেহ উদ্ধার করে।
দুর্ঘটনাস্থলে উপস্থিত মীরসরাইয়ের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিনহাজুর রহমান জানান, উদ্ধার কার্যক্রম শেষে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও রেলওয়ে কর্মীদের সহায়তায় প্রায় আড়াই ঘণ্টা চেষ্টার পর ট্রেনের সম্মুখে আটকে থাকা মাইক্রোবাসটি ট্রেন থেকে সরানো হয়। প্রায় তিন ঘণ্টা ঢাকা-চট্টগ্রামের এই রেলরুট অচল থাকার পর সচল হয়েছে।
দুর্ঘটনা কবলিত মহানগর প্রভাতির যাত্রী রেলের উপ-সহকারী পরিচালক (চট্টগ্রাম) লিংকন মজুমদার জানান, হঠাৎ শব্দ হয়ে ট্রেনের ধীরগতির পর বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নেমে পরিস্থিতি দেখে আমিও দায়িত্ব পালন শুরু করি। রেলওয়ের সকল প্রকার বিভাগকে সচল করে নিহতদের উদ্ধার এবং রেল লাইন সচল করি। তিনি বলেন, এমন দুর্ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত।
এদিকে উক্ত দুর্ঘটনার প্রধান কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, খৈয়াছড়া রেল গেটে সাদ্দাম হোসেন (৩৫) নামের গেটম্যান গেট বন্ধ করে জুমার নামাজে গিয়েছিলেন। কিন্তু অজ্ঞাত সিএনজি চালক গেট পিলার তুলে দিলে সেটি আর কেউ বন্ধ করেনি। এমতাবস্থায় মাইক্রোবাসটির চালকের অমনোযোগিতায় রেললাইনে উঠে গেলে দুর্ঘটনাটি ঘটে। আর ট্রেন মাইক্রোটি নিয়ে প্রায় পৌনে এক কিলোমিটার দূরে গিয়ে থামে। মীরসরাই থানার ওসি কবির হোসেন ও ফায়ার সার্ভিস স্টেশন কর্মকর্তা ইমাম হোসেন বলেন, মাইক্রোটি ট্রেনের ইঞ্জিনের মুখে এতোটা আটকে না থাকলে হয়তো দুর্ঘটনার ভয়াবহতা আরো কম হত। মাইক্রোটি ট্রেন থেকে ছাড়াতে প্রায় ৪০ সদস্যের পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মী হাঁফিয়ে উঠে।
ঘটনার ব্যাপারে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী আবুল কালাম চৌধুরী আজাদীকে জানান, দুর্ঘটনার পরপরই আমি গেটম্যানের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি। এখন সরেজমিনে ঘটনাস্থলে আসলাম। গেটম্যান আমাকে জানিয়েছে ঐ সময় তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন। একই সময়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী একটি ট্রেন ক্রসিং পার হওয়ার পর গেটম্যান গেট ফেলেছিল। কিন্তু মাইক্রোবাসের ড্রাইভার মনে করেছিল ট্রেন চলে গেছে-আর ট্রেন আসবে না। তখন তিনি ব্যারিকেড তুলে চলে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মাইক্রোবাস চালক ব্যারিকেড তুলে ক্রসিং পার হওয়ার সময় ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দিকে আসা মহানগর প্রভাতী ট্রেনটি মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দেয়। এতে মুহূর্তের মধ্যে এই দুর্ঘটনা ঘটে। আমরা বিষয়টি তদন্তের জন্য দুটি কমিটি করেছি। গেট কিপার ঐ সময় ছিল কিনা, কার দোষে এই ঘটনা ঘটেছে, সেটা তদন্তে জানা যাবে।
রাতে নিহতদের লাশ হস্তান্তর : এদিকে ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত ১১ জনের লাশ গতকাল রাত সাড়ে ১০টায় আইনি প্রক্রিয়া শেষে তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। নিহত ১১ ছাত্র-শিক্ষক সকলে হাটহাজারীর হওয়ায় ঘটনার পরপর চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ সালাম প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্রুত আইনি প্রক্রিয়া শেষে লাশগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তরের ব্যবস্থা করেন। এ ব্যাপারে এম এ সালাম জানান, নিহত ১১ জন সবাই আমার এলাকার। পরিবারগুলো একদিকে নিজেদের স্বজনদের হারিয়ে বেদনা ভারাক্রান্ত। তার উপর দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ায় পড়লে লাশগুলো পেতেও তাদের অনেক কষ্ট হবে। তাই আমি রেলওয়ে পুলিশ প্রশাসনকে বলেছি- আইনি প্রক্রিয়া শেষ লাশগুলো দ্রুত পরিবারের কাছে হস্তান্তরের জন্য। এর আগে মীরসরাইয়ে দুর্ঘটনায় নিহত ১১ জনের লাশ ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানায় আনা হয়।
রেলওয়ে পুলিশ সুপার হাছান চৌধুরী জানান, আমরা আইনি প্রক্রিয়া শেষে মরদেহগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছি। এটি যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনা। সেহেতু ওসি তার ক্ষমতাবলে নিহতদের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করেছেন। চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানার ওসি মো. নাজিম উদ্দিন বলেন, থানায় লাশ আনার পর এগুলো শনাক্ত করা হয়। এর আগে এসব লাশের সুরতহাল করা হয়। পরে নিহতদের স্বজনদের লিখিত আবেদনে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ হস্তান্তর করা হয়।
হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা : গভীর রাতে জিআরপি থানা থেকে যখন লাশগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছিল তখন রেলওয়ে থানা এলাকায় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। বুক ভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা। একে একে ১১টি অ্যাম্বুলেন্সে করে এসব লাশ বাড়িতে নিয়ে যান স্বজনরা।
লাশ হস্তান্তরের সময় রেলওয়ে থানায় উপস্থিত ছিলেন, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ সালাম, চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন মো. ইলিয়াছ চৌধুরী, রেলওয়ে পুলিশ সুপার মো. হাসান চৌধুরীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবেঁচে ফেরা ৬ জন চমেকে চিকিৎসাধীন
পরবর্তী নিবন্ধশিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলো না মারুফের