রম্যসাহিত্যিক অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ

মো. খোরশেদ আলম | শনিবার , ২৭ মে, ২০২৩ at ৬:২৬ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের বাঁশখালীর কৃতী সন্তান সাহিত্যে মরণোত্তর একুশে পদকপ্রাপ্ত (২০০৫) সাবেক প্রাদেশিক সদস্য অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ। ১৯৯৪ সালের ২৮ মে সন্ধ্যা ৭টায় ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ১৯১৪ সালের এপ্রিল মাসে তিনি বাঁশখালী উপজেলায় সাধনপুর গ্রামের এক সচ্ছল কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মুন্সী সফর আলী ও মা নাসিমা খাতুন। ১৯৩২ সালে বাণীগ্রাম হাইস্কুল থেকে ১ম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৩৪ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে আই এ, ১৯৩৬ সালে বি এ এবং ১৯৩৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪১ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে অধ্যাপনায় যোগদান করে পরবর্তীতে মহসিন কলেজ, ফেনী কলেজ, লাকসাম কলেজ ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুনামের সাথে শিক্ষকতা করেন। ’৫২ এর ভাষা আন্দোলনে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের বিভিন্ন দাবী আদায়ের সংগ্রামে তিনি নেতৃত্ব প্রদান করেন। ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে যুক্তফ্রন্টের টিকেটে তিনি এম পিএ নির্বাচিত হন। চট্টগ্রাম সিটি কলেজ, সাধনপুর পল্লী উন্নয়ন উচ্চ বিদ্যালয়, বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজ, পশ্চিম বাঁশখালী উচ্চ বিদ্যালয়, রত্নপুর উচ্চ বিদ্যালয় সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মহান ব্যক্তি বহু গ্রন্থের প্রণেতা ছিলেন। ২৭টিরও অধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর। তার অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজ জামে মসজিদ সংলগ্ন প্রিয় বৃক্ষ কৃষ্ণচূড়ার নীচে ২৯ মে তাকে সমাহিত করা হয়। আমার মরহুম পিতা আবদুল মাবুদ সওদাগরের সাথে তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। আমাদের শহরের (রহমতগঞ্জ) বাসায় প্রায় তিনি আসতেন এবং রাত্রিযাপন করতেন। আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর কথা বলতেন, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতেন। অত্যন্ত সাদাসিধা চলাফেরা ও নিরহংকারী মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর শৈশব কেটেছে সাধনপুরের নিজ গ্রামের বাড়িতে। ছোটোবেলা থেকেই তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক। ছাত্র হিসেবে খুব মেধাবী ছিলেন রাজনীতি করে অল্প সময়ে তিনি অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠে ছিলেন। মাটি ও মানুষের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা ছিল শোষিত নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি লড়াই সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করে গেছেন। এসবের মাঝে তিনি হয়ে উঠেন একজন প্রতিভাধর লেখক। তাঁর লেখাগুলি সমাজের অন্যায় অসত্যের বিরুদ্ধে দারুণভাবে রেখাপাত করে। তাঁর লিখনিতে ফুটে উঠে সাধারণ মানুষের কথা। সমাজের বিবেককে জাগিয়ে তুলতে সৃজনশীল লিখা ও মেধা মননে তাঁর কোনো বিকল্প ছিল না। তিনি সবসময় প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে সাধারণের কাছে পরিচিত ছিলেন। তাঁর লেখার মধ্যে হাসিঠাট্টার ভেতর দিয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও অবিচারকে তুলে ধরা হয়েছিল গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, রাজনীতিকে প্রচার করার মাধ্যমে জনপ্রিয় করা হয়েছে, প্রোপাগান্ডার আকারে নয়, সাহিত্যের রূপে। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। এটাই ছিল অধ্যাপক আসহাব উদ্দীনের দর্শন। তার প্রতিটি লেখার মাঝে ছিল সাধারণ মানুষের প্রতি অগাধ বিশ্বাস আর ভালোবাসা।

সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ সাবেক এম পিএ অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ আজীবন সাম্যবাদী ধারায় রাজনীতি করে গেছেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে টাকা আনা পাই, দাম শাসন, দেশ শাসন, বাদলের ধারা ঝরে ঝর ঝর, ধার, ঘুষ, সেরে এক আনা মাত্র, জান ও মান, বন্দে ভোটারাম, বোকা মিয়ার ইতিহাস, আসহাব উদ্দীন আহমদ রচনা সমগ্র (তিন খণ্ড) বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রকাশিত আসহাব উদ্দীন আহমদ এর সেরা রম্যরচনা প্রভৃতি।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের পর থেকে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেন এবং কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে দেন। মার্কসবাদে উদ্ধুদ্ধ হয়ে যোগ দেন কৃষক, শ্রমিক ও জনতার পাশে। বিপ্লবী রাজনীতির অনুসারী হওয়ায় তাকে পাকিস্তান আমলে এক বছর জেল খাটতে হয়। আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসার পর তার রাজনীতি নিষিদ্ধ হয় এবং তার নামে হুলিয়া জারি হয়। ১৯৫৭ সালে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ন্যাপ এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত আন্ডারগ্রাউন্ড হুলিয়া নিয়ে জীবন কাটাতে হয়। পাকিস্তান সরকার তাকে ধরে দেয়ার জন্য পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। ১৯৬৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টি দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেলে তিনি পিকিং পন্থিদের সাথে ছিলেন এবং ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চট্টগ্রামের লালদিঘির মাঠে ৬ দফা ঘোষণা দিলে পরের দিন তিনি বলেছিলেন, লালদিঘির পানি যেমন লাল নয়, ৬ দফা দফা নয়। পরে তিনি তাঁর বক্তব্যের জন্য অনুতপ্ত হয়েছিলেন বলে শোনা যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। সেই সময় অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন বিভিন্ন গ্রামে কৃষকদের বাড়িতে তাদের আশ্রয়ে আত্মগোপন করে কাটান। ১৯৮০ সালে কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে গণচীন সফর এ বছরের শেষের দিকে সক্রিয় রাজনীতি হতে অবসর গ্রহণ করেন। ২১ পদক ছাড়া তিনি বৌদ্ধ একাডেমি পদক, অনুপম পদক, চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্র পরিষদ পদক, আইনজীবী সমিতি পদক, বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম গবেষণা কেন্দ্র পদক পুরস্কার লাভ করেন।

১৯৫২ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সামশুল হক অসুস্থ হলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং সেই কমিটির সভাপতি ছিলেন মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী। তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ৩৩ সদস্য বিশিষ্ট সে কমিটিতে অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন নির্বাহী সদস্য ছিলেন। এছাড়া ৫৪’ এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারনায় শেখ মুজিবুর রহমান চট্টগ্রাম সফরে এলে একদিনের জন্য তিনি বাঁশখালী আসহাব উদ্দীনের বাড়িতে এসেছিলেন এবং রাত্রিযাপন করেন বলে শোনা যায়। ২৯ তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আমি তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতবাসী করেন। আমীন। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক : সাবেক শ্রম বিষয়ক সম্পাদক, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅনিমেষ ভাবনা কৃষ্ণচূড়ায়
পরবর্তী নিবন্ধরাউজান এক অগ্রসর জনপদের নাম