রনি একবার যেটা বলে, বলতেই থাকে। থামানো যায় না। এবারও যে বৈশাখি মেলা হচ্ছে না, তা কোনোভাবেই বুঝানো যাচ্ছে না তাকে। সেই সকাল থেকে কেঁদেকেটে বাড়ি মাথায় তুলছে। আরে বাবা, গত এক বছর ধরে করোনাভাইরাস তাণ্ডবে গোটা পৃথিবী স্থবির। প্রতিদিন কত মানুষ যে প্রাণ হারাচ্ছে। কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না এই মহামারি। একটু কমে তো আবার বাড়ে। রীতিমত আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানও কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না! বছরের অধিক সময় ধরে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। জীবন জীবিকার তাগিদে ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত খোলা থাকলেও কোথাও সেই স্বাভাবিক পরিবেশ নেই। সেখানে আবার মেলা!
রনিকে বাবা-মা এত বোঝানোর পরও ওই একটাই কথা- মেলায় যাবে, হাতি কিনবে, ঘোড়া কিনতে, মন্ডা মিঠাই খাবে। বায়নার শেষ নেই। আর বায়না করবেই না বা কেন? একে তো বয়স কম, মাত্র সাতে পা দিয়েছে। তারওপর বুদ্ধি হবার পর থেকে এই লালদীঘির মেলা দেখেই তো বড় হচ্ছে রনি।
বৈশাখ মাস এলেই গেরাম-গঞ্জে কত মেলা, খেলা হয়। কিন্তু ইট-পাথরের এই শহরে সেই সুযোগ কোথায়। মেলা, খেলা যা-ই বলি ওই একটাই- লালদীঘির মেলা। তবে বিশ্বজুড়ে এর পরিচিতি জব্বারের বলীখেলা নামে। ঐতিহ্যবাহী এই খেলাটি চালু হয় ১৩১৫ বঙ্গাব্দ (১৯০৯ ইংরেজি) ১২ বৈশাখ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে দেশের তরুণ যুবসমাজকে সংগঠিত করার জন্য আব্দুল জব্বার নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এই খেলাটি চালু করেন। যুগে যুগে এই খেলার পরিচিতি দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে এখন বিশ্বব্যাপী। দেশের দূর-দূরান্ত থেকে নামিদামি বলীরা আসেন খেলায় লড়তে। সেরা বলীকে দেয়া হয় নগদ অর্থসহ অসংখ্য পুরস্কার। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘির মাঠে এই খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এর আশপাশের বিশাল এলাকাজুড়ে বসে বৈশাখি মেলা। মেলার কয়েকদিন আগের থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা এসে জড়ো হতে থাকে। এসময় পুরো নগরীতে সাজ সাজ রব উঠে। চট্টগ্রামের মানুষ তো বটেই সারাদেশের মানুষ এই মেলার জন্য সারাবছর অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী মেলাটি করোনার কারণে দুবছর ধরে না হওয়ার কষ্ট শুধু ছোটদের নয় বড়দেরও। এই মেলা বিনোদনের তো বটেই, গেরস্থালীর যাবতীয় পণ্যের যোগানও দেয়। যা অন্য মেলায় পাওয়া যায় না। তাই অনেকে বসে থাকেন ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্তর কিনবে সে আশায়। ছোটখাটো ব্যবসায়ীরাও কত আশা নিয়ে এই দিনটির অপেক্ষায় থাকেন। মেলায় বেচাকেনা করে দুটো পয়সা ইনকাম করবে তারা। কিন্তু মহামারি করোনা তাণ্ডবে সব গুঁড়েবালি!
রনি বাঁশির সুরে কখন যে বাবার হাত ছেড়ে বাঁশিওয়ালার পিছু নিয়েছে বুঝতে পারেনি। রনি একা নয়, ছেলে-বুড়ো আরও অনেকে বাঁশিওয়ালার মনকাড়া বাঁশির সুরে পিছু নিয়েছে। যেন হ্যামিলনের সেই বাঁশিওয়ালা, জাদুকরি বাঁশির সুরে রাজ্যের সব ইঁদুরগুলোর মত পিছু পিছু ছুটছে ছেলে-বুড়ো সবাই।
হঠাৎ রনির খেয়াল হল সাথে বাবা নেই। ততোক্ষণে অনেকদূর চলে এসেছে। এখন কী হবে! এদিক ওদিক তাকায়। শুধু মেলা আর মেলা, মানুষ আর মানুষ। চারদিকে টমটমের কড়মড় শব্দ। ডুগডুগি আর ভুভুজেলা বাঁশির কান ফাটানো আওয়াজ। দোকানির হাঁকডাক। বাবা-বাবা বলে চিৎকার করে মরলেও কেউ শুনবে না। মন খারাপ করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে রনি। পাশ দিয়ে বেলুনওয়ালাকে যেতে দেখে ডাক দেয়, ‘বেলুনওয়ালা ও বেলুনওয়ালা, আমাকে একটা বেলুন দাও না।’
‘কোনটা নেবে, বলো?’
‘ওটা দাও। লাল রঙের একদম বড়টা।’
‘বিশ টাকা লাগবে।’
‘অত টাকা তো নেই। দশ টাকায় দাও না।’
‘দশ টাকায় পাবে ছোটটা। ওটা পনেরো টাকা লাগবে।’ বলে বেলুনওয়ালা চলে যায়। রনির মনটা আরও খারাপ হয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে বাবাকে খোঁজে আর মেলা দেখে। কী সুন্দর মেলা। হরেক রকমের পসরা সাজিয়ে বসেছে হাজার হাজার দোকানি। ঘরদোর সাজানোর জিনিস, বাঁশ-বেত আর কাঠের আসবাবপত্র। মজার মজার খাবার দোকান। খেলনার দোকান। মাটির তৈরি হাঁড়িপাতিল, গরু, ঘোড়া, হাতি, সিংহ, বাঘ, হরিণ, ফুলদানি কী নেই মেলায়। যেন পুরো দেশের সব জিনিসপত্তর এক জায়গায় এসে হাজির! মাটির তৈরি বড় বড় হাতি, ঘোড়াগুলো দেখে রনির আর ওখান থেকে সরতে মন চায় না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে আর ভাবে, ইস বাবা সাথে থাকলে কিনে নিতে পারতাম।
জন্মদিনে বাবা কথা দিয়েছিল, লালদীঘির মেলা থেকে দুটি বড় বড় হাতি আর ঘোড়া কিনে দেবে। সেই থেকে ১২ই বৈশাখ দিনটির অপেক্ষায় ক্যালেন্ডারের পাতায় রনি প্রতিদিন দাগ কাটে।
রনির চোখের সামনে লোকজন কত কিছু কিনছে। কিন্তু রনি কিছু কিনবে দূরে থাক, একটু মণ্ডা মিঠাই যে খাবে তাও কপালে জুটছে না। পকেটের দশ টাকাটা শুধু শুধু। এত কম টাকায় কিছুই কেনা যাচ্ছে না। বাবা সাথে থাকলে এতক্ষণে কত কিছু খাওয়া হতো। কত কিছুই কেনা হতো। রনির কান্না চলে আসে।
চোখ মুছতে মুছতে আবার সামনের দিকে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে লালদীঘি মাঠের সামনে। লোকজনে মাঠটা গিজগিজ করছে। বলীখেলা শুরু হয়ে গেছে। ঢোলের শব্দে মাঝে মাঝে মাঠ কেঁপে ওঠছে। রনি পায়ে ভর দিয়ে মাথা খাড়া করে খেলা দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু বড় বড় মানুষের মাথার উপর দিয়ে দূর থেকে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
রনি গতবার বাবার কাঁধে উঠে খেলা দেখেছে। মানুষে মানুষে সেকী লড়াই। একজন অন্যজনকে কাঁধে তুলে ধপাস করে মাটিতে ফেলে দেয়। মাটিতে পড়ে যাওয়া লোকটি আবার উঠে লড়াই শুরু করে। এভাবে চলতে থাকে লড়াই। শেষে শক্তি এবং কৌশলের জোরে একজন জিতে যায়। রনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বাবা থাকলে এবারও খেলাটা দেখতে পারতো। কিন্তু……।
হঠাৎ পেছন থেকে বাবার গলা শুনতে পায় রনি। ফিরে তাকাতেই রনির ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে দেখে বাবা তাকে গায়ে হাত দিয়ে ডাকছে, ‘উঠ বাবা, সন্ধ্যা হয়ে এলো। মেলা মেলা করে কাঁদতে কাঁদতে সেই কখন ঘুমিয়ে গেলি।
দুপুরেও কিছু খাসনি। এমন পাগলামু কেউ করে, বাবা!’ রনি হেসে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে। বাবাও হেসে একটা মিষ্টি চুমু দেয় রনির কপালে।