যোগাযোগ হয়নি জলদস্যুদের সঙ্গে, শঙ্কা নিয়ে অপেক্ষা

সোমালিয়ার উপকূলের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জাহাজটিকে

| বৃহস্পতিবার , ১৪ মার্চ, ২০২৪ at ৮:২৩ পূর্বাহ্ণ

ভারত মহাসাগরে যে জলদস্যুরা বাংলাদেশি জাহাজের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে, তারা ২৪ ঘণ্টায়ও এর মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। মালিকপক্ষও নানাভাবে চেষ্টা করে জলদস্যুদের নাগাল পাচ্ছে না। ফলে এখন পর্যন্ত করণীয় ঠিক করতে পারেনি জাহাজের মালিকানায় থাকা এসআর শিপিং ও তাদের মূল কোম্পানি কবির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। কর্মকর্তারা বলছেন, তারা জলদস্যুদের কাছ থেকে যোগাযোগের অপেক্ষায় আছেন। ২০১০ সালে একই কোম্পানির আরো একটি জাহাজ এভাবে নিয়ে গিয়েছিল সোমালীয় জলদস্যুরা। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে এই জাহাজটি উদ্ধারে আত্মবিশ্বাসীও কর্মকর্তারা। নানা সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, জলদস্যুরা বাংলাদেশি জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ‘ও তার ২৩ নাবিককে সোমালিয়ার উপকূলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। খবর বিডিনিউজের।

মঙ্গলবার দুপুরে মোজাম্বিক থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে আরব আমিরাত যাবার পথে ভারত মহাসাগরের সোমালি উপকূল থেকে ৪৫০ নটিক্যাল মাইল দূরে জলদস্যুরা এমভি আবদুল্লাহর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়, জিম্মি করে এর ২৩ নাবিককে। জিম্মিদশা অবস্থাতেই জাহাজের চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খান ও নাবিকরা তাদের পরিবারের সদস্য এবং মালিকপক্ষকে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বার্তা এবং ভয়েস মেইল পাঠান। তবে গতকাল বুধবার সকাল থেকে জাহাজের কারো সঙ্গে যোগাযোগ নেই বলে মালিক এবং স্বজনদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। কারণ, জলদস্যুরা নাবিকদের মোবাইল ফোন নিয়ে গেছে।

গতকাল বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬ টা ৪০ মিনিটে জাহাজটি সোমালিয়ান উপকূল থেকে ১৭০ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছিল বলে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাখাওয়াত হোসেন জানান। সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে এসআর শিপিংয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম বলেন, ‘বলা যায় গত ২৪ ঘন্টায় জাহাজের কারও সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। জিম্মিকারীদের পক্ষ থেকেও যোগাযোগ হয়নি। এমভি আবদুল্লাহ এখনো স্টপ হয়নি।এটিকে উপকূলের দিকে নেয়া হচ্ছে বলে ধারণা করছি।’

২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর একই কোম্পানির এমভি জাহান মণির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় জলদস্যুরা। তারা সেটিকে ছয়দিন পর সোমালিয়ার উপকূলীয় এলাকা গারাকোডের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। ওই জাহাজের অভিজ্ঞতা থেকে জলদস্যুদের পক্ষ থেকে যোগাযোগের প্রত্যাশা করছে মালিকপক্ষ। এসআর শিপিং কোম্পানিটি কবির গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। এই গ্রুপের মিডিয়া ফোকাল পারসন মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা জলদস্যু এবং জাহাজের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। কিন্তু এখনো কোনো যোগাযোগ স্থাপন হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘তাদের একটা কৌশল হল জাহাজ ক্যাপচার করার পর তারা সেইফ জোন তৈরি করে। তারপর সেখান থেকে নিজেদের দাবি জানায়। এখনও পর্যন্ত যোগাযোগ না হওয়ায় জলদস্যুদের কোনো দাবির বিষয়ও আমরা জানি না।’

১৪ বছর আগে জাহাজসহ অপহৃত নাবিকের মনে ‘অন্য এক ভয়’

প্রায় দেড় দশক আগে মহাসাগরে জাহাজ থেকে অপহরণের শিকার এক নাবিক জানিয়েছেন, সোমালীয় জলদস্যুরা অপহৃতদেরকে ‘নির্যাতন বা দুর্ব্যবহার করে না’। তবে এক ধরনের আশঙ্কা থাকে, সেটি হল ‘জলদস্যুদের একাধিক দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব।’ ২০১০ সালে একই ধরনের ঘটনার শিকার হয় বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি জাহান মণি। সে বার অপহরণের শিকার হন ২৫ জন। প্রায় সাড়ে তিন মাস পর মুক্তি পেয়ে দেশে ফেরেন তারা। সেই জাহাজের নাবিক মো. ইদ্রিস বলেছেন, জলদস্যুদের এই দলটিকে নিয়ে তিনি শঙ্কিত নন, তবে ভয়ের অন্য একটি কারণ আছে। তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার (আজ) ওরা পৌঁছাবে সোমালিয়ায়। সেখানে আরেকটা গ্রুপও হয়ত হামলা করতে পারে, ওদের কাছ থেকে জাহাজটি নেওয়ার জন্য। সোমালীয় দস্যুদের হাতে অস্ত্র আছে। একে৪৭ এর নিচে কোনো অস্ত্র নেই তাদের।’

এই দ্বিতীয় পক্ষ হাজির না হলে অবশ্য দুশ্চিন্তার কিছু নেই বলে মনে করেন ইদ্রিস। সোমালিয়ায় মাস তিনেক বন্দি জীবন কাটিয়ে আসার অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন, ‘পরিবারগুলোকে বলব, এখানে টেনশনের কিছু নাই। ওরা (জলদস্যুরা) মুক্তিপণ পেলে এদেরকে (নাবিকদের) ছেড়ে দেবে। ওরা কোনো নির্যাতন করবে না। জাহাজে পর্যাপ্ত প্রভিশন মানে খাবার ও পানি আছে। এদিক দিয়েও চিন্তার কিছু নেই।’

জলদস্যুরা ইংরেজি ও আরবিতে কথা বলতে পারে জানিয়ে মো. ইদ্রিস বলেন, ‘আমাদের কথা বলতেও সমস্যা হয়নি। আর এস আর শিপিং যথেষ্ট সহযোগিতা করে। আমাদের ফ্যামিলিকে যতটুকু গাইড দেয়া দরকার দিয়েছে। যতটুকু সাপোর্টিং দরকার করেছে।’

যে শঙ্কার কথা বলেছেন আবদুল্লার নাবিক

এমভি আবদুল্লাহর চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খান তার স্ত্রীর কাছে পাঠানো এক অডিও বার্তায় বলেছেন, ‘এই মেসেজটা সবাইকে পাস করে দিও। আমাদের থেকে মোবাইল নিয়ে নিচ্ছে আরকি। ফাইনাল কথা হচ্ছে যে, এখানে যদি টাকা না দেয়, আমাদেরকে একজন একজন করে মেরে ফেলতে বলছে। এদেরকে যত তাড়াতাড়ি টাকা দিবে, তত তাড়াতাড়ি ছাড়বে বলছে। এই মেসেজটা সবাইকে পাস করে দিও। এখন মোবাইল নিয়ে নিচ্ছে।’

তবে ইদ্রিস মনে করেন, এই মেরে ফেলার আশঙ্কা কম। তিনি বলেন, ‘জলদস্যুরা আমাদের সঙ্গে যথেষ্ট ভালো আচরণই করেছে। কাউকেই নির্যাতন করেনি। টাকা পাওয়ার পরই ছেড়ে দিয়েছে।’ এই সময়ে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘অস্ত্রের মুখে থাকায় আমরা আতঙ্কে ছিলাম। তখন কিন্তু আমরা ফ্যামিলির সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারিনি। এবার নাবিকরা পরিবারের সঙ্গে শর্ট টাইমে যোগাযোগ করতে পেরেছে। আমরা মিনিমাম ৫ দিন পর ফ্যামিলির সঙ্গে কথা বলছিলাম। তবে আমরা মোটামুটি ভালোই ছিলাম। কোনো সমস্যা ছিল না।’

বিবিসি বাংলা জানায় : কেএসআরএম গ্রুপের মিডিয়া অ্যাডভাইজার মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘সাধারণত দস্যুদের একটি ক্যারেক্টার থাকে। তারা আটকের পরই কোনো ডিমান্ড করে না। তারা আসলে একটা সেইফ জোন খুঁজে। সেইফ জোন তৈরি করার পর তারা আমাদের ডিমান্ড দিবে। দেন দরবার করবে। এখনো হয়তো সেইফ জোনে তারা পৌঁছাতে পারেনি বলেই হয়তো এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারেনি।’

এমন পরিস্থিতি গতকাল বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘জিম্মি নাবিকরা এই মুহূর্তে সুস্থ ও নিরাপদে আছে। আমরা নাবিকদের নিরাপদে উদ্ধার ও জাহাজটিকে রক্ষা করার চেষ্টা করছি।’

বাসস জানায় : শুধু এমভি আবদুল্লাহ নয়; আরও অনেক জাহাজের বাংলাদেশি নাবিক ও ক্রু সোমালিয়ান জলদস্যুদের কাছে অতীতে জিম্মি হয়েছিলেন। তাদের কেউ ২০ মাস পর, কেউ ১০ মাস পর জিম্মি দশা থেকে মুক্তি পান। ২০১২ সালে সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে ২০ মাসেরও বেশি সময় জিম্মি থাকার পর বাংলাদেশি সাত নাবিক মুক্তি পান। ২০১০ সালের ২৬ নভেম্বর ভারত মহাসাগর থেকে মালয়েশিয়ার পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আলবেডোক আটক করে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। তখন জাহাজটিতে থাকা ২২ কর্মকর্তা এবং ক্রুকে জিম্মি করা হয়। ওই ২২ জনের মধ্যে ছিলেন ৭ বাংলাদেশি, ৭ জন পাকিস্তানি, ৬ জন শ্রীলঙ্কান ও একজন করে ভারতীয় এবং ইরানি নাগরিক। তাদের সবাই মুক্তিপণ দিয়ে দীর্ঘ সময় পর মুক্ত হয়েছিলেন।

কেএসআরএম গ্রুপের আরেকটি জাহাজ এমভি জাহান মনি মুক্তিপণ দিয়ে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবল থেকে ছাড়া পায় একশ’ দিন পর। জিম্মি হওয়ার আট মাস পরও সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার ঘটনার সাক্ষী আছেন দুই বাংলাদেশি নাবিক। তারা হলেননাবিক জাফর ইকবাল ও গিয়াসউদ্দিন আজম খান। তারা আটক হওয়া ‘এমভি মারিয়া মার্গারেট’ নামের জার্মান পতাকাবাহী জাহাজে কর্মরত ছিলেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাহে রমজানের সওগাত
পরবর্তী নিবন্ধভেজা চট পেঁচিয়ে রাখা সিলিন্ডার দেখে কৌতূহলীদের ভিড়, তখনই আগুন