যে কেউ চাইলেই বিদেশে এমবিবিএস ডিগ্রি নয়

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ৯ মার্চ, ২০২৩ at ৪:৪১ পূর্বাহ্ণ

দেশের মেডিকেল শিক্ষায় আমূল পরিবর্তন আসছে। আগে যে কেউ চাইলেই বিদেশে গিয়ে এমবিবিএস/বিডিএস কোর্সে অধ্যয়ন করতে পারতেন। তবে এখন থেকে সে সুযোগ আর থাকছেনা। বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি প্রক্রিয়াতেও বড়সড় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এতদিন বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে নিজেরাই মেধা তালিকা তৈরি করে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করতো। তবে এবার এ নিয়মে পরিবর্তন আসছে। এখন থেকে সরকারি মেডিকেল কলেজের মতো বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর মেধা তালিকাও অটোমেশনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে তৈরি করা হবে। ‘মেডিকেল/ডেন্টাল কলেজে এমবিবিএস/বিডিএস কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তি নীতিমালা২০২৩’এ এসব পরিবর্তনের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। গত ৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. লিয়াকত হোসেনের স্বাক্ষরে এ নীতিমালা প্রকাশ করা হয়েছে।

নীতিমালায় নতুন কয়েকটি পরিবর্তনের তথ্য নিশ্চিত করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সাহেনা আক্তার আজাদীকে বলেন, এবারের এমবিবিএস/বিডিএস ভর্তি নীতিমালায় কয়েকটি নিয়মে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এই পরিবর্তন মেডিকেল শিক্ষার জন্য অবশ্যই ইতিবাচক।

নীতিমালার ৭ অনুচ্ছেদের ৭.২ উপঅনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো শিক্ষার্থী দেশের বাইরে এমবিবিএস/বিডিএস কোর্সে অধ্যয়ন করতে চাইলে তাকে বাধ্যতামূলকভাবে এমবিবিএস/বিডিএসএর কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে। ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণপূর্বক সর্বনিম্ন ৪০ নম্বর প্রাপ্ত হলে তিনি বিএমএন্ডডিসির (বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল) ‘এলিজিবিলিটি সার্টিফিকেট’ প্রাপ্তির জন্য নির্ধারিত ফরমে আবেদন দাখিল করবেন। বিএমএন্ডডিসি সংরক্ষিত ফলাফল থেকে প্রার্থীর ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল যথাযথভাবে যাচাইবাছাই করবে। বিএমএন্ডডিসির এই ‘এলিজিবিলিটি সার্টিফকেট’ প্রাপ্তি সাপেক্ষে কোনো শিক্ষার্থী বিদেশে অধ্যয়নের জন্য যেতে পারবেন। তবে দেশের বাইর হতে এমবিবিএস বা সমমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তাকে বিএমএন্ডডিসির অধীনে ‘রেজিস্ট্রেশন কোয়ালিফাইং এঙাম’এ অংশ নিতে হবে। উক্ত ‘রেজিস্ট্রেশন কোয়ালিফাইং এঙাম’ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিএমএন্ডডিসির সাময়িক সনদ প্রাপ্তি সাপেক্ষে ওই প্রার্থী স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক নির্ধারিত বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্নশীপ করার সুযোগ পাবেন। তবে এসব শিক্ষার্থীকে কোনোভাবেই সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্নশীপের জন্য বিবেচনা করা যাবে না।

আর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ে নীতিমালার ৪ অনুচ্ছেদএর উপ অনুচ্ছেদ ৪.১ এবং ৪.৪ থেকে ৪.এ বলা হয়েছে, ভর্তি পরীক্ষায় কৃতকার্য পরীক্ষার্থীদের মধ্য থেকে সরকারি মেডিকেল কলেজের অনুমোদিত মোট আসন সংখ্যার সাথে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের তারিখে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অনুমোদিত আসন সংখ্যার ৫ গুণ শিক্ষার্থীকে নিয়ে জাতীয় মেধা তালিকা প্রকাশ করা হবে। তবে ভর্তি পরীক্ষায় ৪০ নম্বরের কম প্রাপ্ত প্রার্থীরা কোনোভাবেই ভর্তির যোগ্য বিবেচিত হবে না।

সরকারি মেডিকেল/ ডেন্টাল কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়া (২য় অপেক্ষামান তালিকা পর্যন্ত) সমাপ্ত হবার পর বেসরকারি মেডিকেল কলেজ/ডেন্টাল কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হবে। এ লক্ষ্যে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর ভর্তি কার্যক্রমের একটি সিডিউল প্রস্তুত করে ওয়েবসাইটে প্রচারের পাশাপাশি বহুল প্রচারের ব্যবস্থা করবে।

প্রস্তুতকৃত জাতীয় মেধা তালিকার শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ/ডেন্টাল কলেজ/ডেন্টাল ইউনিটে ভর্তিচ্ছুদের আবেদন পুনরায় অনলাইনে গ্রহণ করা হবে। পুনরায় আবেদন দাখিলের সময় তালিকা হতে সরকার স্বীকৃত সকল বেসরকারি মেডিকেল কলেজ/ডেন্টাল কলেজ/ডেন্টাল ইউনিটের পছন্দক্রম উল্লেখ করতে হবে।

বেসরকারি মেডিকেল কলেজ/ডেন্টাল কলেজ/ডেন্টাল ইউনিটে ভর্তির জন্য অনলাইনে আবেদন দাখিলের নির্ধারিত সময়ের পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রার্থীর মেধাক্রম ও পছন্দক্রম অনুযায়ী কোন প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগপ্রাপ্ত হয়েছে তা প্রার্থীকে এসএমএসএর মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হবে এবং নির্বাচিত প্রার্থীদের কলেজভিত্তিক তালিকা প্রকাশ করা হবে।

নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (সর্বোচ্চ ৫ দিন) নির্বাচিত প্রার্থীকে যে প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছেন, সে প্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে সম্মতির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। প্রথমবার সম্মতি নিশ্চিতকরণের পর শূন্য থাকা আসনসমূহে অপেক্ষামানদের মধ্য হতে আবেদনের সময় দেওয়া পছন্দক্রম ও মেধাক্রম অনুযায়ী ২য় বারের মতো শিক্ষার্থী নির্বাচন করে তালিকা প্রকাশ করা হবে এবং পুনরায় এসএমএসএর মাধ্যমে নির্বাচিত প্রার্থীকে জানিয়ে দেয়া হবে। ২য় বারে নির্বাচিতদেরও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (সর্বোচ্চ ৫ দিন) নিশ্চিত করতে হবে যে, তিনি যে কলেজের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন, সেখানে ভর্তি হতে সম্মত আছেন। সম্মত প্রার্থীদের (১ম ও ২য় বারে) মধ্য হতে মেডিকেল কলেজওয়ারী নির্বাচিত প্রার্থীদের সমন্বিত তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। ১ম ও ২য় বারে নির্বাচিত প্রার্থীদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করে সংশ্লিষ্ট কলেজকে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরকে অনলাইনে অবহিত করতে হবে। এরপরও কোনো প্রতিষ্ঠানে আসন শূন্য থাকলে একই প্রক্রিয়ায় ৩য় বারে শিক্ষার্থী নির্বাচন করা হবে। ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার পর কোনোভাবেই এক বেসরকারি মেডিকেল কলেজ/ডেন্টাল কলেজ/ডেন্টাল ইউনিট থেকে অন্য বেসরকারি কলেজ/ইউনিটে মাইগ্রেশন করা যাবেনা। সরকার নির্ধারিত ক্লাস শুরুর তারিখের পর কোনোভাবেই শিক্ষার্থী ভর্তি করা যাবেনা।

নীতিমালায় নতুন নিয়ম সংযোজনকে মেডিকেল শিক্ষার ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন বলছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. ইসমাইল খান ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সাহেনা আক্তার।

উপাচার্য ইসমাইল খান বলেন, আগে যে কেউ দেশের বাইরে গিয়ে এমবিবিএস বা বিডিএস ডিগ্রি নিয়ে আসতে পারতো। অবশ্য ডিগ্রি নিয়ে আসলেও তাদের বিএমএন্ডডিসির কোয়ালিফাইং এঙামে অংশ নেয়ার বাধ্যবাধকতা আগে থেকেই ছিল। কিন্তু বিদেশে অধ্যয়ন করতে যাওয়ার আগে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করার বাধ্যবাধকতা আগে ছিল না। এবার নতুন সংযোজন করা হয়েছে। এটি অবশ্যই বড় পরিবর্তন। এর মাধ্যমে যে কেউ চাইলে বিদেশে গিয়ে এমবিবিএস বা বিডিএস কোর্সে পড়তে পারবে না। তাকে আগে দেশের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে অবশ্যই পাস নম্বর পেতে হবে। তবেই সে বাইরে গিয়ে মেডিকেল শিক্ষায় অধ্যয়ন করতে পারবে। নতুন এ নিয়ম মেডিকেল শিক্ষার গুণগত পরিবর্তন আনবে বলে মনে করেন তিনি।

এদিকে, সরকারি মেডিকেলের মতো বেসরকারি মেডিকেল কলেজ/ডেন্টাল কলেজেও কেন্দ্রীয়ভাবে ভর্তির বিষয়টি ভালো একটি সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন মেডিকেল শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এই নিয়ম শিক্ষার্থীঅভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সবার জন্য স্বস্তিকর। কারণ, এতদিন বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা নিয়ে নিজেদের পছন্দমতো শিক্ষার্থী ভর্তির অভিযোগ ছিল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে। উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে মেধা তালিকায় এগিয়ে থাকা শিক্ষার্থীকে বাদ দিয়ে পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থী ভর্তির অভিযোগও কম নয়। আর এ সুযোগ প্রতিষ্ঠানগুলো পেত নিজেদের মতো করে তালিকার তৈরির সুযোগ ছিল বলে। তবে এবার থেকে সে সুযোগ আর থাকছে না। এখন থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরই কলেজ ভিত্তিক নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের তালিকা তৈরি করে দেবে। এ তালিকা ধরেই ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এটিও একটি শুভ পরিবর্তন বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডা. মো. ইসমাইল খান। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে মেডিকেল শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের পাশাপাশি মেডিকেল শিক্ষায় আসতে আগ্রহী শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা স্বস্তি বোধ করবেন বলে আমার বিশ্বাস। সরকারি মেডিকেল কলেজের আদলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ/ডেন্টাল কলেজেও কেন্দ্রীয়ভাবে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করার সিদ্ধান্তটি অবশ্যই ইতিবাচক বলছেন চমেক অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. সাহেনা আক্তার। নতুন নিয়মকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) চট্টগ্রামের সভাপতি ডা. মুজিবুল হক খান বলেন, এটি অবশ্যই ইতিবাচক পরিবর্তন। এর মাধ্যমে মেডিকেল শিক্ষায় কোয়ালিটি কন্ট্রোল সহজ হবে।

প্রসঙ্গত, ১০ মার্চ (শুক্রবার) দেশব্যাপী একযোগে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবারের (২০২২২৩ শিক্ষাবর্ষের) এমবিবিএস প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা। দেশের ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন রয়েছে ৪ হাজার ৩৫০টি। আর বেসরকারি ৭১টি মেডিকেল কলেজে আসন সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৬ হাজার। এসব আসনে ভর্তি হতে সারাদেশে ১ লাখ ৩৯ হাজার ২১৭ জন পরীক্ষার্থী এবার ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস কোর্সের আসন রয়েছে ২৪০টি। এ কেন্দ্রের অধীন ৫টি ভেন্যুতে এবার ১৩ হাজার ১২৭ জন পরীক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনীরব ঘাতক কিডনি রোগ বাড়ছে যেসব কারণে
পরবর্তী নিবন্ধইবাদত বন্দেগির মধ্য দিয়ে পবিত্র শবে বরাত পালিত