ওরা বলেছিল মায়ের ভাষা কেড়ে নেবে !
গর্জে উঠেছিল বাংলার দামাল ছেলেরা। জব্বার, বরকত, সালাম। রক্তে লাল হয়েছিল রাজপথ। ফাগুনের রংও কিন্তু পলাশ রং। অর্থাৎ লাল।
একুশ আমার অহংকার-একুশে মানে মাথা নত না করা। একুশ এমন এক চেতনার নাম যা যুগে যুগে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছে এবং যার ধারাবাহিকতায় আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ।
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন ‘Urdu and only Urdu shall be the mother language of Pakistan’ বাংলার দামাল ছেলেরা সেই দম্ভোক্তি মিথ্যা করে দিয়েছিল।
একুশের সঙ্গে আমাদের পরিবার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ঢাকায় গুলি চলার পর- রক্তরঞ্জিত রাজপথের শহীদদের উদ্দেশ্যে প্রথম কবিতাটা লিখেন কবি মাহবুব-উল আলম চৌধুরী। তিনি চট্টগ্রামের মানুষ। কবিতার নাম- ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। একুশেই তিনি কবিতাটি শেষ করেন।
ঢাকায় গোলাগুলি এবং প্রাণহানির কথা জানতে পেরে পরদিন লালদীঘির মাঠে প্রতিবাদ সভার ডাক দেয়া হলো। এই কবিতাটি সেখানে পাঠ করা হবে। এবং সম্ভব হলে এই কবিতাটি ছাপিয়ে বিলি করা হবে।
এই কবিতা ছাপার ভার পড়ল বর্তমানে এমটিবির এমডি আনিস এ খানের পিতা কামাল এ খানের উপর। তিনি সেই সময় কাগজের ব্যবসা করতেন। সেই সুবাদে আমার বাবা কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের কর্ণধার মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের কাছে আসতেন। এখানে বলে রাখা ভাল- যদিও আমার বাবা ১৯২৩ সালে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ইলেকট্রিক বিষয়ে ডিগ্রি নেন। সম্ভবত তিনিই বাংলাদেশের প্রথম মুসলমান ইঞ্জিনিয়ার। আমার জানা মতে, তিনিই পিকে সেনের হাত ধরে চট্টগ্রামে প্রথম বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সূচনা করেছিলেন।
কিন্তু সেই সময় লেখাপড়ায় পশ্চাদপদ মুসলিম সমাজকে সচেতন করার মানসে, চাকরি ছেড়ে ১৯৩২ সালে কোহিনূর লাইব্রেরী ও পরে কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস স্থাপন করেন তিনি। এখনো আমাকে অনেকে জিজ্ঞাসা করেন- সব ছাপাখানার মেশিনই তো বিদ্যুৎচালিত। তা সত্ত্বেও আপনাদের প্রেসের নামের সঙ্গে ‘ইলেক্ট্রিক’ শব্দটি লাগানো হলো কেন? আসল ব্যাপারটা হলো, কোহিনূর প্রেসেই প্রথম পদচালিত ট্রেডেল মেশিনে মোটর সংযুক্ত করে বেল্টের মাধ্যমে চালানো হয়েছিল। এ কারণেই এর নামের সঙ্গে ‘ইলেক্ট্রিক’ শব্দটা যোগ করা হয়। বোধ হয় এটা করা হয়েছিল ‘মার্কেটিং’ সুবিধার জন্যে।
যাক, যে কথা বলছিলাম, কামাল সাহেব সেদিন সন্ধ্যার দিকে কিছু না জানিয়ে বাবার কাছে হাজির হলেন আমাদের বাসায়। সেই সময় আমরা প্রেসের দোতলায় থাকতাম। অনেকক্ষণ তাদের মধ্যে কথাবার্তা হলো। বাবা সেই কবিতা ছাপতে রাজি হলেন। কারণ এই কবিতা ছাপা মানে রাষ্টদ্রোহিতা। পরবর্তীতে জেল জরিমানা, বন্দী জীবন।
তখন সব কাজ হাতে টাইপ বসিয়ে করা হতো। যা বর্তমানে কম্পিউটার মাধ্যমে করা হয়। সেই সময় পাটোয়ারী নামে আমাদের একজন কম্পোজিটার ছিলেন। তিনি নিচে প্রেসেই থাকতেন। তাকে ডেকে এর গুরুত্ব বুঝিয়ে বুঝিয়ে কবিতার কপিটা দেয়া হলো। বলা হলো- অতি গোপনীয়তার সাথে প্রেসে কোনো বাতি না জ্বালিয়ে, শুধু মোমবাতির সামান্য আলোয় কাজ সারতে হবে। যে কোনো মুহূর্তে পুলিশ এসে যে হানা দিতে পারে- সে ব্যাপারেও তাকে সতর্ক করা হলো।
তিনি কাজ শুরু করলেন। রাত প্রায় ১১টা। পুলিশ কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে হানা দিল। পাটোয়ারী পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে মেটারসহ কবিতাটি লুকিয়ে ফেলেন। বাবাকে অনেক জেরা করা হলো। কিন্তু উনি কিছুতেই স্বীকার করলেন না যে প্রেসে ছাপার জন্যে কিছু এসেছে। পুলিশ প্রেসে ঢুকে অনেক কিছু তছনছ করে চলে গেল।
পুলিশ যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আবার কাজ শুরু হলো। ছাপা হলো সেই কবিতা। পরদিন লালদীঘির সমাবেশে কবিতাটি পাঠ করা হলো। কিন্তু দুঃখ/সুখের বিষয় হলো কবিতার পেছনে প্রেসের নামটাও ছাপা হয়ে গিয়েছিল। রাতে যথারীতি পুলিশ আবার হানা দেয়। তারা এবার এসেছে বাবাকে ধরে নিতে, কারণ কবিতাটা তিনি কেন ছাপালেন। সে সময় আমাদের প্রেসের ম্যানেজার ছিলেন আমার দাদা সম্পর্কের দবির আহমদ চৌধুরী। তিনি বললেন, আমার সাহেব এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। আমি কিছুই না বুঝে কবিতাটা ছেপেছি। আপনারা নিলে আমাকে নিতে পারেন। পুলিশ তখন তাকেই ধরে নিয়ে গেল। পরে মামলা হলো। দবির সাহেবের সাজা হলো। পরবর্তীতে ৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার আসলে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
যে মেশিনে কবিতাটি ছাপা হয়েছিল, সেটি কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে সংরক্ষণ করা আছে, ইতিহাসের অংশ হিসেবে।
যে ২১ শের প্রথম কবিতা নিয়ে এত কাণ্ড- সেই কবিতার লেখক মাহবুবউল আলমকে একুশে পদক পেতে মাত্র ৩৯ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আমার মনে হয় এই কবিতা যদি ঢাকার কোনো কবি লিখতেন এবং ঢাকার কোনো প্রেস থেকে ছাপা হতো তা হলে প্রেসের মালিক, কম্পোজিটার ম্যানেজার সকলকে ৫/৭ বছরের মধ্যে একুশে পদক দিয়ে সম্মানিত করা হতো। যদিও তারা সম্মান বা কোনো পদক পাওয়ার আশায় এই কাজ করেননি। যা করেছেন দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি ভালবাসা থেকেই করেছেন।
এখানে আর একটা কথা বলে রাখি, আমরা বাঙালিরা মারা যাওয়ার পর মানুষকে মূল্যায়ন করি- যাতে জীবদ্দশায় তার কৃতকর্মের কোনো প্রশংসাই সে না পায়। তাতে একটা লাভ আছে। তার আত্মীয়স্বজনরা বলতে পারেন-আমার বাবা, আমার চাচা, আমার দাদা অমুক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। চিন্তা করে দেখেন, এই পুরস্কারটা উনি পেয়েছেন-উনার জীবদ্দশায় করা কাজের জন্য। আমার মনে হয় এই ব্যাপারে আমাদের আর একটু উদার হওয়া প্রয়োজন।