যেমন ভোট হলো ৬৪ ইউপিতে

কেন্দ্র দখল, বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে আহত ৩৬ পটিয়ায় স্বতন্ত্র দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর ভোট বর্জন

আজাদী ডেস্ক | সোমবার , ২৭ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:১২ পূর্বাহ্ণ

চতুর্থ ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে গতকাল রোববার বৃহত্তর চট্টগ্রামের ৬৪ ইউনিয়নে ভোট হয়েছে। পটিয়ায় কেন্দ্র দখল, হাতাহাতি ও ফাঁকা গুলি বর্ষণ হয়েছে। এখানে আহত হয়েছেন ২০ জন। লোহাগাড়ায় প্রার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ, বিচ্ছিন্ন ঘটনায় ১৬ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া ব্যালট পেপার সংরক্ষণ করায় দুজনকে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে চকরিয়ায়।
পটিয়ায় সংঘর্ষ, কেন্দ্র দখল, ফাঁকা গুলি : পটিয়া প্রতিনিধি জানান, পটিয়া ও কর্ণফুলীর ২১ ইউনিয়ন পরিষদে গতকাল রোববার ভোটগ্রহণ হয়েছে। কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল থেকে দুই উপজেলার বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে ভোটারদের উপস্থিতি। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে পটিয়ার বেশ কিছু কেন্দ্রে নৌকার প্রার্থী ও সমর্থকদের কেন্দ্র দখল, ব্যালটে সিল মারা ও কেন্দ্রে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ করেন স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীরা। পটিয়ার ছনহরা ইউপির ধাউরডেঙ্গা, রমেশ ফনিন্দ্র স্মৃতি পাঠাগার কেন্দ্র ও সারদা চরণ উচ্চ বিদ্যালয় মঠপাড়া ৪ নং ওয়ার্ডে নৌকার চেয়ারম্যান প্রার্থী সামশুল আলম ও স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী ও বর্তমান চেয়ারম্যান আবদুর রশিদ দৌলতির সমর্থকদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।
কর্ণফুলীর চরলক্ষ্যায় নৌকার চেয়ারম্যান প্রার্থী সোলায়মান তালুকদার ও তার কর্মী সমর্থকদের কেন্দ্র দখলসহ নানা অভিযোগে চশমা প্রতীকের স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী মোহাম্মদ আলী দুপুরে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। একই উপজেলার শিকলবাহায় মধ্যম শিকলবাহা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে নৌকার কোনো এজেন্ট দেখা যায়নি।
ধাউর ডেঙ্গা সারদা চরণ উচ্চ বিদ্যালয় ও রমেশ ফনিন্দ্র স্মৃতি পাঠাগার কেন্দ্র থেকে সিল ও ব্যালট ছিনতাইয়ের অভিযোগে সকাল সাড়ে ১০টার সময় কেন্দ্র দুটিতে ভোটগ্রহণ স্থগিত করে প্রশাসন। বিষয়টি নিশ্চিত করে উপজেলা নির্বাচন অফিস। এদিকে একই ইউপিতে মঠপাড়া কেন্দ্রে বই প্রতীকের সংরক্ষিত আসনের প্রার্থী কহিনুর আকতার ও কলম প্রতীকের প্রার্থী বিবি মরিয়মের সমর্থকদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।
পটিয়ার কাশিয়াই ইউপির বুধপুরা পশ্চিম পাড়া ফোরকানিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রে দুপুর দেড়টায় নৌকার প্রার্থী আবুল কাসেম ও স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী মোহাম্মদ কাইছের (আনারস) সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ বেশ কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে। এ সময় দুই প্রার্থীর সমর্থকরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে।
জিরি ইউনিয়নের বিভিন্ন কেন্দ্রে নৌকার সমর্থকদের ভোট কেন্দ্র দখল ও জোর করে চশমা প্রতীকের স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ বাবুলকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগ করেন। দুপুরে তিনি নিজ বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন।
নির্বাচনে হাতাহাতির ঘটনায় পটিয়ার ছনহরায় নৌকার প্রার্থী সামশুল আলমের পুত্র মামুনুর রশিদ রাসেল (৪১), তার ভাই হাবিবুর রশিদ সাকিল (৩২), সামশুদ্দিন (৬০), তানবীর (২২), দক্ষিণ জিরিতে আবদুর রহমান (৪৮), হাবিবুর রহমান (৩৮), কচুয়াই ইউনিয়নে জিকু (২০), চম্পক চক্রবর্তী (৩০), আরেফিন (২০), আমিনুল ইসলাম (২৭), আয়েছ উদ্দিন (২৫), কালারপোলে সাইফুদ্দিনসহ (৫১) ২০/২৫ জন আহত হন। আহতদের অধিকাংশ পটিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নেন।
লোহাগাড়ায় আহত ১৬, দুজনকে দণ্ড : লোহাগাড়া প্রতিনিধি জানান, লোহাগাড়ার ৬ ইউনিয়নে বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ছাড়া সুষ্ঠু পরিবেশে ভোট হয়েছে। ইউনিয়নগুলো হলো বড়হাতিয়া, পদুয়া, চরম্বা, কলাউজান, পুটিবিলা ও চুনতি।
জানা যায়, সকালে চুনতি হাফেজিয়া আদর্শ মাদরাসা কেন্দ্রে আগে থেকে নৌকা প্রতীকের ব্যালেট পেপারে সিল মারা ও প্রার্থী জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে ভোট কেন্দ্রে অবৈধভাবে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ পাওয়া যায়। চুনতি ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের ডাক বাংলো ভোট কেন্দ্রে চশমা প্রতীকের স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীর কোনো এজেন্টকে দেখা যায়নি। প্রার্থী নুর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ জানান, ওই কেন্দ্র থেকে তার সব এজেন্টকে বের করে দেয়া হয়েছে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেন নৌকার প্রার্থীর পুত্র ছাত্রলীগ নেতা এরশাদুর রহমান।
চুনতি ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের পানত্রিশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে এজেন্টদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের অভিযোগ পাওয়া যায়। পরে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বজলুর রহমান কয়েকটি বুথে গিয়ে এজেন্টদের কাছ থেকে মোবাইল উদ্ধার করেন।
কলাউজান ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের পশ্চিম কলাউজান খতিবিয়া দাখিল মাদরাসা কেন্দ্রে দুপুরে ভোটারের দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। কলাউজান ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের কলাউজান ডা. এয়াকুব বজলুর রহমান সিকদার উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুপুর দেড়টায় পুরো ভোট কেন্দ্র ভোটারশূন্য দেখা যায়। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. আজম খান জানান, কেন্দ্রে বহিরাগত কিছু লোক আসার কারণে একটু বিশৃক্সখলা সৃষ্টি হয়।
কলাউজান ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের আদারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুই মেম্বার প্রার্থী সেলিম উদ্দিন ও রফিক আহমদ সিকদারের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় আধ ঘণ্টার মতো ভোটগ্রহণ বন্ধ ছিল। সংঘর্ষে মেম্বার পদপ্রার্থী সেলিম উদ্দিন আহত হন।
পদুয়া ইউনিয়নে ২ নং ওয়ার্ডের পদুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে মেম্বার প্রার্থী মো. শাহজাদা মিঞা ও মো. শব্বির আহমদের সমর্থকদের সাথে ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া হয়। এতে মো. হামিদ নামে এক সমর্থক আহত হন। বিশৃক্সখলার কারণে সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ বন্ধ থাকে। পরে ভোট হয়। চরম্বা ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডে দক্ষিণ চরম্বা এন ইসলাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আড়াইটার দিকে দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
লোহাগাড়ায় নির্বাচনী সংঘর্ষে ১৬ জন আহত হয়েছেন। তারা হলেন পদুয়া ইউনিয়নের নয়া পাড়ার দানু মিয়ার পুত্র মো. হামিদ (৩৬), আলী সিকদার পাড়ার আহমদ কবিরের পুত্র ভুট্টু (৫০), জিন্নাত আলী পাড়ার আহমদ কবিরের পুত্র এরশাদুল করিম (২৫), মো. হোসেনের পুত্র মো. ফারুক (৪০), হদ্দলী পাড়ার আলী আহমদের পুত্র ইমন হোসেন (১৬), মালী পাড়ার এয়াকুব আলীর পুত্র আইয়ুব আলী (৫৫), মীর পাড়ার আবদুল মোমেনের পুত্র শাহেদ হোসেন (৩৫), হানিফের পাড়ার মো. ইউসুফের পুত্র হাজী রহমত উল্লাহ (৭৪), পদুয়া মল্লিক ছোবহান এলাকার আবুল বশরের পুত্র নুরুল আমিন (৩০), কলাউজান ইউনিয়নের হিন্দুরহাট এলাকার কবির আহমদের মেয়ে রুজিনা আক্তার (৪২), উত্তর কলাউজান হিন্দুরহাট এলাকার ইউসুফ সিকদারের পুত্র তাজউদ্দিন (৩৮), আনজু সওদাগরের পাড়ার নুরুন্নবীর মেয়ে কহিনুর আক্তার (৪০), পুটিবিলা ইউনিয়নের গৌড়স্থান এলাকার আবুল হোসেনের পুত্র মো. মহসিন (৪৭), কক্সবাজার সদরের চৌধুরী পাড়ার মো. ইউনুছের পুত্র মো. ওমর ফারুক (৩৭) ও সাতকানিয়ার ছদাহা এলাকার মো. জহির উদ্দিনের পুত্র আইয়াছ উদ্দিন (১৩)। এছাড়া কলাউজান ৯ নং ওয়ার্ডের মেম্বার প্রার্থী মো. সেলিম উদ্দিন আহত হন।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্তব্যরত চিকিৎসক শেখ মোহাম্মদ ফয়সাল জানান, ১৫ জন হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৭ জনকে আশঙ্কাজনক অবস্থা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। অন্যদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়।
পদুয়ার ২ নং ওয়ার্ডের পদুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ব্যালট পেপার সংরক্ষণ করায় দুজনকে কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। সাজাপ্রাপ্তরা হলেন পারভেজ (২২) ও মোস্তাফিজ (৫০)। পারভেজকে এক বছর ও মোস্তাফিজকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
চকরিয়ায় শান্তিপূর্ণ ভোট : চকরিয়া প্রতিনিধি জানান, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট হয়েছে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বাকি ৮ ইউনিয়ন হারবাং, বরইতলী, ফাঁসিয়াখালী, চিরিঙ্গা, বমু বিলছড়ি, ডুলাহাজারা, খুটাখালী ও সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়নে।
গতকাল সকাল থেকে প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে নারী ও পুরুষ ভোটারদের দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়। কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটারের এই স্রোত বিকাল পর্যন্ত ছিল। তবে ফাঁসিয়াখালী ও ডুলাহাজারায় ইভিএমে ভোট হওয়ায় কয়েকটি কেন্দ্রে সন্ধ্যার পরও ভোটারদের লাইন ছিল। নারীদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট জটিলতার কারণে দুই ইউনিয়নের এসব কেন্দ্রে জটিলতা দেখা দেয়। কেন্দ্রের ভেতর থাকা ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার পর ফলাফল দেওয়া হয় বলে প্রিসাইডিং অফিসাররা জানিয়েছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, দুপুরে ডুলাহাজারা ইউনিয়নের মাইজপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গোলযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। তাৎক্ষণিক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আইন-শৃক্সখলা বাহিনীর সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়। চিরিঙ্গা ইউনিয়নের একটি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের এক বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে গণ্ডগোল সৃষ্টির চেষ্টা করা হলে মামুন নামের ওই প্রার্থীর ভাইপোকে আটক করে আইন-শৃক্সখলা বাহিনী। এছাড়া বাকি ইউনিয়নগুলোতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন সম্পন্ন হয়।
আইন-শৃক্সখলা সমন্বয়কারী ও ইউএনও সৈয়দ শামসুল তাবরীজ বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্পন্ন হয়েছে।
এছাড়া রাঙামাটি সদরের ছয়টি, নানিয়ারচরে চারটি, কক্সবাজারের টেকনাফের তিনটি, বান্দরবানের রোয়াংছড়ির চারটি ও থানচির চারটি, খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ির তিনটি, মানিকছড়ির তিনটি ও রামগড়ে দুটি ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসোনালী ব্যাংকের সেই এমডি হুমায়ুনসহ ১১ জনের কারাদণ্ড
পরবর্তী নিবন্ধকক্সবাজারে এবার স্কুলছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগে মামলা