আবুলের মা এবার না করেনা।
বলে,- আবুল যুদ্ধে যা।
আবুল ভীষণ খুশি। ওর সব বন্ধুরা কখন যুদ্ধে গেছে। তখন মা যেতে দেয়নি। ভয়ে। যদি গুলিতে মারা যায়! গ্রামের প্রতি পরিবার থেকে যুদ্ধে গেছে। সে লজ্বায় আবুল ঘর থেকে বেরুয় না।
হঠাৎ মা’র সাহসী মুখের কথা শুনে আবুল অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
– মা, সত্যি বলছো যুদ্ধে যাবো।
– হ্যাঁরে বাবা,আর মানা নয়,সত্যিসত্যিই তুই যুদ্ধে যা।জন্মভূমিকে স্বাধীন কর। চোখের সামনে এই নির্মম অত্যাচার,মানুষের মৃত্যু দেখতে চাইনা।
আবুল যুদ্ধে যাবার জন্য তৈরি হয়।
আজ মাঝে রাতেই গ্রাম ছাড়বে সে। সঙ্গে অরুন, খালেদও যাবে। রাত শেষে ওরা বেরুয়।
বেরুবার আগে মা আবুলকে জড়িয়ে কাঁদে। আবুল মাকে বলে,
– মা, তুমি দোয়া করো। যুদ্ধজয়ে ফিরতে পারি।
আবুল,অরুণ, খালেদ যুদ্ধের ট্রেনিং নেয়। তাদের বন্ধুদের দেখা হয়।
কমান্ডার আলতাফ সবাইকে এক গ্রুপে নেয়।তা’তে আবুলেরা ভীষণ খুশি। কমান্ডার আলতাফের নেতৃত্বে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওরা।
পথম প্রথম পাকসেনাদের সাথে পেরে উঠছিলোনা। মিত্রবাহিনী যুদ্ধে নামতেই মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি বাড়ে।
আবুলেরা যুদ্ধ করতেকরতে নাজিরহাটে পৌঁছে। তাদের কমান্ডারের বাড়ি নাজিরহাটে। বাকী সবার বাড়িও কাছাকাছি।
পানজাবির বড়ো একটি দলের ঘাঁটি এখানে। ঐ ঘাঁটি উড়িয়ে দেবার
অর্ডার এসেছে হাইকমান্ড থেকে।
গভীর রাত। ঝুপঝুপ বৃষ্টি। মেঘের ঘনঘন গর্জন।আলতাপ সবাইকে ডাকে। কমান্ডার আলতাফ বলে,
– এটা আমাদের জন্মভূমি।এটাকে শত্রুমুক্ত করতে হবে। শুনেছি প্রায়ই চল্লিশজনের পানজাবীসেনার দল।ওদের অনেক ভারিঅস্ত্র আছে। আমাদেরও কম নেই। তবে অস্ত্র গোলাবারুদ একটু কম। বুদ্ধিতে ওদের শেষ করতে হবে।
ঠিক তখনই আনজুম খবর নিয়ে আসে। আবুলের বাবাকে পাকসেনারা গুলি মেরে হত্যা করেছে। রাজাকার সোলেমান আরো বলে,
– যেই পরিবার থেকে মুক্তিযোদ্ধা গেছে, সবার বাবাকে এভাবে মারবে।
কমান্ডার আলতাফ অস্ত্রহাতে চেঁছিয়ে উঠে।রাগে গুলি ছাড়তে উদ্যত হয়।
আঁউমাঁউ কেঁদেকেঁদে আবুল বললো,
– না কমান্ডার,তুমি গুলি ছুড়োনা। গুলির শব্দে পানজাবীরা জাগবে।গুলি ছুঁড়বে।আমরা সবাই মরবো। মাথা ঠান্ডা করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
কমান্ডার আলতাফের মেজাজটা ভীষণ গরম। আবুলের কথায় শান্ত হয়। তারপরে জিগ্যেস করে,
– চাচাকে কবর দিয়েছ?
– হ্যাঁ, দিয়েছি। আনজুম উত্তর দেয়।
আবুল শিশুর মতো কাঁদে। কমান্ডার গলা নামিয়ে বলে,
– আবুল, আমরা মুক্তিযোদ্ধা। এভাবে কাঁদতে নেই। আমাদের প্রতিশোধ নেবার সময় এখন। কাল কিভাবে ঐ পানজাবী দলকে শেষ করবো তাই নিয়ে আলোচনা হউক।
আবুল বলে,
– কমান্ডার,আমাদের সুযোগ হবে যদি বৃষ্টি থাকে। বৃষ্টিতে পানজাবীরা
ঘুমিয়ে থাকবে। দুইএকজন হয়তো পাহারায় থাকবে। আমরা তাদের অনেকটা কাছাকাছিতে আছি।সুযোগে চতুরমুখি আক্রমণ করতে হবে।তা’হলে ওরা পরাজিত হবে।মারা যাবে।
– আমি শুরুতে বলেছি,আমাদের অস্ত্র কম।বুদ্ধিতে শত্রু ঘায়েল করতে হবে।
– কিভাবে কমান্ডার? সেটাই বলো।
– বৃষ্টি থাকলে ভালো,যদি না থাকে! তা’হলে আমাদের চার গ্রুপে ভাগ করে যুদ্ধ করতে হবে। প্রথম গ্রুপে থাকবে বেশি দলের। ওদের হাতে থাকবে ভারি অস্ত্র,এবং গ্রেনেড। শুরুতেই ভারি অস্ত্র এবং গ্রেনেড ছোঁড়া। তারপর সবাই চুপ। পানজাবীরা তখনও গুলি ছুঁড়বে। গুলির শব্দ থামলেই পেছনের দল গুলি ছুঁড়বে।
ফাঁকে প্রথম দল আবারও। শুধু ভারি অস্ত্রে গুলি ছুঁড়বে।
তারপর আবারও চুপ।
আমরা চারপাশ থেকে আক্রমণ করবো।
সবাই দারুণ বলে চীৎকার করে।
কমান্ডার বলে,
-আজ এতটুকু। সবাই বিশ্রাম নাও।
পরের দিনের জন্য সবাই অপেক্ষায় থাকে। সারাদিন মেঘে ঢাকা আকাশ। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে হাসি।মনেমনে বলে যদি বৃষ্টি থামে, দারুণ হবে যুদ্ধ করতে। পরপর ঝুপঝুপ বৃষ্টি।
বিকেল গড়ায়।সন্ধ্যা নামে। রাত বাড়ে।
কমান্ডার আলতাফ বলে,
– সবাই খেয়ে নে। যুদ্ধ শুরু করার সময় হলো।
আবারও বৃষ্টি।
কমান্ডারের আদেশ,ঝাঁপিয়ে পড় সবাই।
চতুর্দিক থেকে আক্রমণ শুরু। গুলির শব্দ ছাড়া যেন আর কিছু নেই।
পাকসেনারা পাল্টা গুলি ছোঁড়ে।অনেকক্ষন। আলতাফ বাহিনী চুপ।
পাকসেনাদের গুলি থামতেই আলতাফ বাহিনী ঝড়োবেগে গুলি ছুঁড়ে।সাথে চতুর্দিক থেকে গ্রেনেড নিক্ষেপ।
পাকসেনাদের গুলির শব্দ নেই।
আলতাফ বাহিনীর গুলিও থামে। প্রচন্ড কান্নার শব্দ কানে আসে।
রাত শেষ হয়।ভোরের পাখি ডাকে।
আলতাফ ভারি অস্ত্রে গুলি ছোঁড়ে। পাকসেনারা গুলির প্রতিউত্তর দেয়না। ভোরের আলোয় স্পষ্ট দেখা যায় ধোঁয়া। আলতাফ ভাবে,সব পাকসেনারা শেষ।
জয়বাংলা বলে সবাই চতুর্দিক থেকে গুলি ছুঁড়তেছুঁড়তে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কাছাকাছি হতেই দেখে সব পানজাবী শেষ।হাতে রক্তমাখা ভারি অস্ত্র।
সব মুক্তিযোদ্ধার মুখে হাসি।
এই হাসি বিজয়ের।
যুদ্ধ জয়ের।