পাঁচ বছর পর মহাকাশে আবারো মানুষ পাঠিয়েছে চীন। তবে ঘুরতে-ফিরতে নয়, থাকতে। এক, দুই বা সাতদিনের জন্য নয়, টানা তিন মাসের জন্য। বৃহস্পতিবার তিন চীনা নভোচারী – নি হাইসেং, লিই বোমিং এবং ট্যাং হংবো – গোবি মরুভূমির একটি উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩৮০ কিলোমিটার দূরে তৈরি নূতন মহাকাশ স্টেশনে রওনা হন। সাত ঘণ্টা পর তাদের বহনকারী শেনজু-১২ নামের ক্যাপসুল বা মহাকাশ যানটি মহাকাশ কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছে। স্টেশনের ভেতর ১৭ মিটার লম্বা আর চার মিটার চওড়া সিলিন্ডার আকৃতির কক্ষে- যেটির নাম দেওয়া হয়েছে তিয়ানে – এই তিন নভোচারী থাকবেন, মহাকাশে হাঁটবেন, দেখবেন এবং গবেষণা করবেন। খবর বিবিসি বাংলার।
রওনা হওয়ার সাত ঘণ্টা পর তাদের পৌঁছুনোর খবর আসার পর অভিযান নিয়ন্ত্রণ কক্ষে উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষায় থাকা চীনা বিজ্ঞানীরা উল্লাসে ফেটে পড়েন।
মহাকাশে নতুন একটি স্টেশন তৈরি এবং সেখানে দীর্ঘ সময়ের জন্য মানুষ পাঠানোর ঘটনা মহাকাশে চীনের উত্তরোত্তর ক্ষমতা বৃদ্ধির আরেকটি নিদর্শন।
গত ছয়মাসে মহাকাশে অসামান্য সব বৈজ্ঞানিক সাফল্য দেখিয়েছে চীন। গত বছর ডিসেম্বরে গত প্রায় ৫০ বছরের মধ্যে প্রথম চাঁদ থেকে মাটি ও পাথরের নমুনা নিয়ে এসেছে চীনের পাঠানো একটি রোবট-চালিত মহাকাশযান। মঙ্গলগ্রহে ছয়-চাকার একটি রোবট নামাতে পেরেছে চীন যেটি থেকে নিয়মিত নানা ছবি আসছে। দুটো কাজই ছিল খুবই জটিল।
সেনজাও-১২ নভোযানের কম্যান্ডার নি হাইসেং এবং তার দুই সহযোগীর প্রধান কাজ হবে মহাকাশ কেন্দ্রে তৈরি সাড়ে বাইশ টন ওজনের তিয়ানে মডিউলটিকে সচল করা। নভোযানে ওঠার আগে মি. নি বলেন, সেখানে গিয়ে আমাদের অনেক কিছু করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রথমে মহাকাশে আমাদের ঘর বাঁধতে হবে। নতুন কিছু প্রযুক্তিকে সচল করতে হবে। এগুলো কঠিন কাজ এবং সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। তবে এই মিশনের লক্ষ্য পূরণ নিয়ে আমরা তিনজনই যথেষ্ট আশাবাদী। সিলিন্ডার আকৃতির তিয়ানে মডিউলটি মহাকাশে পাঠানো হয় এপ্রিলে। চীনের নতুন এই মহাকাশ স্টেশনে প্রথম এবং মূল স্থাপনাটি হবে এই মডিউল। পরে আরো দুটি মডিউল যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে চীনের। ফলে, একসময় এটি ৭০ টন ওজনের একটি বড় মহাকাশ স্টেশনের রূপ নেবে যেটি কক্ষপথে ঘুরতে থাকবে। এখানে থাকার জায়গা ছাড়া, বিজ্ঞান ল্যাব এবং মহাকাশ পর্যবেক্ষণের জন্য অত্যাধুনিক হাবল-ক্লাস টেলিস্কোপ থাকবে। আগামী দুই বছর ধরে ধাপে ধাপে নতুন নতুন উপকরণ মহাকাশ স্টেশনটিতে যোগ করা হবে। উপকরণের সাথে যাবে নভোচারীদের বসবাসের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ। বদল হতে থাকবে নভোচারী, একদল যাবে, একদল ফিরে আসবে।
শেনজাও-১২ নভোযানের যাত্রীদের পরিচয় চীন বুধবার পর্যন্ত গোপন রাখে। মিশনের নেতা নি হাইসেংয়ের বয়স ৫৬। তিনি চীনের সবচেয়ে অভিজ্ঞ নভোচারী। এর আগে দুবার তিনি মহাকাশে গেছেন। ২০১৩ সালে তিয়াংগং-১ মহাকাশ কেন্দ্রে গিয়ে তিনি ১৫ দিন ছিলেন। ঐ মহাকাশ স্টেশনটি এখন অকেজো এবং পরিত্যক্ত। মি. নি এর দুই সহযোগী লিউ বোমিং (৫৪) এবং ট্যাং হংবো (৪৫) তারই মতো একসময় চীনা বিমান বাহিনীতে ছিলেন। দুই হাজার আট সালে চীনা নভোচারীদের যে দলটি মহাকাশে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করেছিলেন, সেই দলের সদস্য ছিলেন লিউ বোমিং। ট্যাং হংবো মহাকাশে একেবারে আনকোরা, অনভিজ্ঞ। আগামী তিনমাসে যে জ্বালানি, খাবার এবং অন্যান্য উপকরণ এই তিন নভোচারীর লাগবে তা গত মাসে রোবট চালিত একটি মহাকাশযানে করে তিয়ানেতে পাঠানো হয়েছে। মহাকাশে হাঁটা চলার জন্য দুটো স্পেস-স্যুট রয়েছে সেই চালানে। রোবট চালিত মালবাহী নভোযানটি তিয়ানের সাথে সেঁটে। এই তিন নভোচারী সেখানে গিয়ে থিতু হওয়ার পর সেসব মালামাল, রসদ বের করবেন। চীনের আনহুই প্রদেশের হেফেই শহরের একটি স্কুলের ক্লাসরুমে ছাত্র-ছাত্রীরা টিভিতে শেনজু-১২ নভোযানের উৎক্ষেপণ দেখছে। যুক্তরাজ্যের রয়্যাল অ্যারোনোটিকেল সোসাইটির ফেলো অধ্যাপক কেইথ হেওয়ার্ডও মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া যে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে, চীনেরও লক্ষ্য একই। তিনি বলেন, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও সামর্থ্য জানা দেওয়ার জন্য মহাকাশ প্রকল্প একটি দারুণ উপায়। তাছাড়া, সন্ধান মেলেনি এমন অমূল্য বস্তু বা জ্বালানির সন্ধান মহাকাশে অনেক দেশের মত চীনও করছে।