সারা দেশে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তদের মাঝে ৯৮ ভাগেরও বেশি রোগী বৃহত্তর চট্টগ্রামের। এসব রোগী তিন পার্বত্য জেলাসহ (বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি) চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার বাসিন্দা। তবে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত তিন পার্বত্য জেলায়। এ অঞ্চলে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের হার দেশের মোট আক্রান্তের ৯৪ শতাংশ। আর ম্যালেরিয়াপ্রবণ অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে বান্দরবান পার্বত্য জেলা। জেলাটিতে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের হার দেশে সবচেয়ে বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচি (এনএমসিপি) এবং চট্টগ্রামের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের দপ্তর সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এদিকে, ম্যালেরিয়া নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর ২৫ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী ম্যালেরিয়া দিবস পালন করা হয়। এ বছরও দিবসটি পালন করা হচ্ছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘উদ্ভাবনী কাজে লাগাই, ম্যালেরিয়া রোধে জীবন বাচাই’। জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির তথ্য বলছে, বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে দক্ষিণ এবং উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী ১৩টি জেলার ৭২টি উপজেলায় ম্যালেরিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব রয়েছে। এর মধ্যে পার্বত্য তিন জেলা ম্যালেরিয়াপ্রবণ এবং কক্সবাজার মধ্য ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব থাকা অন্যান্য জেলার মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, শেরপুর ও কুড়িগ্রাম। প্রতি বছর দেশে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর প্রায় ৯৮ শতাংশ এই ১৩ জেলায় সংঘটিত হয়।
এনএমসিপি সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে সারা দেশে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৭ হাজার ২৯৪ জন। এর মধ্যে ৭ হাজার ২০১ জনই বৃহত্তর চট্টগ্রামের ৫ জেলার বাসিন্দা, যা মোট আক্রান্তের ৯৮ শতাংশেরও বেশি (৯৮.৭২ শতাংশ)। হিসেবে ম্যালেরিয়া নির্মূলের আওতাধীন ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলের ৮টি জেলায় বাকি রোগী শনাক্ত হয়েছে। আর গত বছর সারা দেশে ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের। এই ৯ জনই বৃহত্তর চট্টগ্রামের বাসিন্দা।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, তিন পার্বত্য জেলায় এ রোগের ঝুঁকি এখনো অনেক বেশি। গত বছর মোট আক্রান্তের মধ্যে এ তিন জেলায় আক্রান্তের সংখ্যা ৬ হাজার ৮৫০ জনের কম নয়, যা মোট আক্রান্তের ৯৪ শতাংশ।
এদিকে বৃহত্তর চট্টগ্রামে আক্রান্তদের সিংহভাগই বান্দরবানের। পার্বত্য জেলাটিতে গত বছর ৫ হাজার ২২৮ জন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। আর মৃত্যু হয়েছে ২ জনের।
এ তথ্য নিশ্চিত করে বান্দরবানের সিভিল সার্জন ডা. নীহার রঞ্জন নন্দী আজাদীকে বলেন, জেলার তিনটি উপজেলা বিশেষভাবে ম্যালেরিয়াপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত। এগুলো হলো থানচি, লামা ও আলিকদম। এই তিন উপজেলায় আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। আগের বছরের তুলনায় ২০২১ সালে জেলায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ম্যালেরিয়া নির্মূলে সরকারের পাশাপাশি তিনটি সহযোগী সংস্থা জেলায় কাজ করছে।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের বরাতে আজাদীর বান্দরবান প্রতিনিধি জানান, ২০১৯ সালে বান্দরবানে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৭০৯ জন। ২০২০ সালে আক্রান্ত হয় ৪ হাজার ১৬৬ জন। সর্বশেষ ২০২১ সালে ৫ হাজার ২২৮ জন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়া ২০২০ ও ২০২১ সালে দুজন করে রোগীর মৃত্যু হয়েছে। তবে এটি সরকারি হিসাব। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে দাবি স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টদের।
চট্টগ্রামের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছর বৃহত্তর চট্টগ্রামের ৫ জেলায় মোট ৭ হাজার ২০১ জন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। এর মাঝে কেবল বান্দরবানেই আক্রান্ত ৫ হাজারের বেশি। ২য় সর্বোচ্চ আক্রান্ত জেলা রাঙামাটি। এ জেলায় দেড় হাজারের বেশি আক্রান্ত। ৩য় সর্বোচ্চ আক্রান্ত কঙবাজার জেলায় (৫শর কম)। খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম জেলা আক্রান্তের দিক দিয়ে ৪র্থ ও ৫ম অবস্থানে।
এসব তথ্য নিশ্চিত করে বিভাগীয় স্বাস্থ্য দপ্তরের বিভাগীয় কীটতত্ত্ববিদ মফিজুল হক শাহ আজাদীকে বলেন, ধারাবাহিকভাবে বান্দরবানই সবচেয়ে বেশি ম্যালেরিয়াপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত। ২০১৬ সাল থেকে প্রতি বছর সর্বোচ্চ সংখ্যক আক্রান্ত হচ্ছে এ জেলায়।
অন্যদিকে, কয়েক বছর ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের হার কমলেও আগের বছরের তুলনায় গত বছর হঠাৎ আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে গেছে বৃহত্তর চট্টগ্রামে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯ সালে বৃহত্তর চট্টগ্রামে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৭ হাজার ২৯৩ জন। ২০২০ সালে আক্রান্তের এ সংখ্যা নেমে আসে ৬ হাজার ১০৪ জনে। কিন্তু সর্বশেষ ২০২১ সালে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ২০১ জনে, যা আগের বছরের তুলনায় ১ হাজার ৯৭ জন বেশি।
আগের বছরের তুলনায় ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে মফিজুল হক শাহ বলেন, করোনার কারণে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধমূলক বেশ কিছু কর্মসূচি স্বাভাবিকভাবে করা যায়নি। এর মাঝে রুটিন সেপ্র করার যে কর্মসূচি সেটি করা সম্ভব হয়নি। প্রতি বছর জুন মাসের দিকে এই সেপ্র করা হয়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে গত দুই বছর সেটি করা যায়নি। তাছাড়া মশার সার্ভে কর্মসূচিও ঠিকভাবে করা যায়নি। সব মিলিয়ে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব কিছুটা বেড়েছে বলে আমরা মনে করছি।
সীমান্তবর্তী পাহাড় ও বনাঞ্চলবেষ্টিত হওয়ায় দেশের পার্বত্যাঞ্চলে ম্যালেরিয়ার ঝুঁকি এখনো অনেক বেশি বলে মনে করেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। বনে ও চা বাগানে কাজ করতে যাওয়া নারী-পুরুষ এ রোগে আক্রান্তের অধিক ঝুঁকিতে আছে বলেও অভিমত সংশ্লিষ্টদের। আর পার্বত্যাঞ্চলে সারা বছর রোগী পাওয়া গেলেও জুন-জুলাই মাসে এ রোগের প্রকোপ খুব বেশি বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক এম এ ফয়েজ। এ রোগ প্রতিরোধের উপায় হিসেবে কীটনাশকযুক্ত মশারি ব্যবহার, সব সন্দেহজনক জ্বরের রোগীর মানসম্মতভাবে ম্যালেরিয়া শনাক্ত বা নিশ্চিত করে যথাযথ চিকিৎসা প্রদান, রোগ ও কীটতাত্ত্বিক নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন নিশ্চিত করার পারমর্শ দিয়েছেন তিনি।
এসব অঞ্চলে ম্যালেরিয়া নির্মূলকরণে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে জানিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যার মধ্যে দুর্গম এলাকায় দক্ষ চিকিৎসক স্বল্পতা ও সহজে চিকিৎসা দিতে না পারা, নগরায়ণ ও সময়ের পরিবর্তিত বাস্তবতায় মানুষের দ্রুত অবস্থানগত পরিবর্তন, সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন অন্যতম।
ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য কীটনাশকযুক্ত মশারি প্রতিদিন সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টানানো, তিন বছর পর পর সাধারণ মশারি কীটনাশকে চুবিয়ে ব্যবহার করা, বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়, ডোবা, নর্দমা, পুকুর, গর্ত পরিষ্কার রাখাসহ অ্যানোফিলিস মশা যাতে বংশবিস্তার করতে না পারে সেজন্য সতর্ক থাকার কথা বলেছেন চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টরা।