মৌসুমেও সস্তায় বিপিসির বিটুমিন

দুই বছরে প্রতি টনের দাম কমেছে ১৫ হাজার টাকা ।। সরকার রাজস্ব বঞ্চিত, লাভ কার

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ১১ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:৫৫ পূর্বাহ্ণ

দেশে চাহিদার মাত্র ১০ শতাংশ বিটুমিন উৎপাদন করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড। তারপরও ভর মৌসুমে সস্তায় বিটুমিন বিক্রি করছে বিপিসি। আবার করোনার প্রাদুর্ভাবের অজুহাতে ২০২০ সালে চারবার এবং চলতি বছরের শুরুতে একবার দাম কমে বিটুমিনের। সব মিলিয়ে গত দুই বছরে বিপিসির প্রতি টন বিটুমিনের দাম কমেছে প্রায় ১৫ হাজার টাকা। দাম কমার কারণে সরকারি প্রতিষ্ঠান রাজস্ব বঞ্চিত হলেও লাভ হচ্ছে সিন্ডিকেটের।
ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমান আজাদীকে বলেন, ইস্টার্ন রিফাইনারির উৎপাদিত বিটুমিনের চাহিদা সবসময় বেশি থাকে। শুষ্ক মৌসুমে চাহিদা এমনিতেই বেশি থাকে। তবে আমরা উৎপাদন করি, দর নির্ধারণ করে পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন।
জানা যায়, মানসম্পন্ন হওয়ার কারণে বিপিসির উৎপাদিত বিটুমিনের চাহিদা দেশজুড়ে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী বিভাগ (এলজিইডি), সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা এবং দেশের মেগা প্রকল্পগুলোতে বিপিসির বিটুমিনের চাহিদা দেওয়া থাকে। এতে বছরে প্রায় ৬ লাখ টনের অধিক বিটুমিনের প্রয়োজন পড়লেও ইস্টার্ন রিফাইনারি উৎপাদন করে ৬০-৭০ হাজার মেট্রিক টন। ইস্টার্ন রিফাইনারি ‘৬০-৭০’ ও ‘৮০-১০০’ দুই গ্রেডের বিটুমিন উৎপাদন করে। মূলত ইস্টার্ন রিফাইনারি বিটুমিন উৎপাদন করলেও এসব বিটুমিন বাজারজাত করে বিপণনকারী তিন প্রতিষ্ঠান। আবার বিটুমিনের মূল্য নির্ধারণ করে বিপিসি।
সূত্রে জানা গেছে, বিপিসির বিটুমিন কম উৎপাদন হওয়ায় চট্টগ্রামসহ সারা দেশে সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে স্থবিরতা শুরু হয়েছে। সেখানে সরকারি বিটুমিনের দাম কমানোর সুফল মিলছে না। জ্বালানি নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, বছরে প্রায় ৬০-৭০ হাজার মেট্রিক টন বিটুমিন উৎপাদন করে ইস্টার্ন রিফাইনারি; যার সবগুলোই বিপণন করে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও এসএওসিএল। বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, ৯ অক্টোবর ইস্টার্ন রিফাইনারিসহ চার বিতরণ কোম্পানিতে বিটুমিনের মজুদ ছিল প্রায় আড়াই হাজার মেট্রিক টন। ইস্টার্ন রিফাইনারিতে ‘৬০-৭০’ ও ‘৮০-১০০’ গ্রেড মিলে বাল্কে বিটুমিন রয়েছে ২ হাজার ২শ টন। একইসাথে ‘৮০-১০০’ গ্রেডের ৬শ ড্রাম, ‘৬০-৭০’ গ্রেডের ৪শ ড্রাম মিলে ১৫০ টন ড্রামজাত বিটুমিন রয়েছে। অন্যদিকে তিন বিতরণ কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনায় ‘৬০-৭০’ গ্রেডের ৪শ ড্রামে রয়েছে ৬০ মেট্রিক টন বিটুমিন।
বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের শুরুতে ‘৬০-৭০’ গ্রেডের ১৫০ কেজির প্রতি ড্রাম বিটুমিনের মূল্য ছিল ৯৪০০ টাকা এবং বাল্কে প্রতি টনের মূল্য ছিল ৫৬ হাজার ৫শ টাকা। বিগত তিন বছরে এ বিটুমিনের দাম শুধুই কমেছে। বিশেষ করে করোনার প্রাদুর্ভাবে লকডাউনের অযুহাতে ২০২০ সালে চার দফায় কমেছে বিটুমিনের দাম।
চলতি বছরের শুরুতে আরেক দফা দাম কমে বর্তমানে ‘৬০-৭০’ গ্রেডের ১৫০ কেজির প্রতি ড্রামের মূল্য ৭২০০ টাকা, ‘৮০-১০০’ গ্রেডের মূল্য ৬৮০০ টাকা। একইসাথে বাল্কে ‘৬০-৭০’ গ্রেডের প্রতি টন বিটুমিনের মূল্য ৪০ হাজার ৩৫৫ টাকা ৫০ পয়সা এবং ‘৮০-১০০’ গ্রেডের প্রতি টনের মূল্য ৩৮ হাজার ৮২ টাকা ১০ পয়সা। হিসেব অনুযায়ী বিগত দুই বছরে ‘৬০-৭০’ গ্রেডের প্রতি টন বিটুমিনে প্রায় ১৫ হাজার টাকা কমেছে।
অভিযোগ আছে, বড় বড় প্রকল্পের ঠিকাদাররা প্রভাবশালী হওয়ায় তদবিরের মাধ্যমে তারা বিপণন কোম্পানিগুলো থেকে বিটুমিন বরাদ্দ নেন। এতে চাহিদা থাকলেও ছোট ঠিকাদাররা সরকারি বিটুমিন পাওয়ার ক্ষেত্রে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। আবার বিপিসির বিটুমিন ছাড়া কোনো কাজ বুঝে নেয় না সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এ দুর্বলতার সুযোগ নেয় প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেট বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে বলয় গড়ে তুলে ইস্টার্ন রিফাইনারি থেকে বিটুমিন ছাড়িয়ে নিয়ে বেশি দামে ছোট ছোট ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করে। ঠিকাদাররা বিপিসির কিছু বিটুমিন প্রকল্প স্থানে দর্শনীয় অবস্থায় রেখে আমদানিকৃত বিটুমিন দিয়ে রাস্তা নির্মাণ কিংবা রক্ষণাবেক্ষণের কাজ সারেন।
আবুল কাশেম নামের এক ঠিকাদার বলেন, বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন, দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন, কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে বিটুমিনের বিস্তর চাহিদা থাকে। তারা ঠিকাদারদের প্রত্যয়নপত্র দিয়ে দেন। এ প্রত্যয়নপত্র প্রদর্শন করে প্রভাব খাটিয়ে বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট পদ্মা, মেঘনা, যমুনা থেকে বিটুমিন বরাদ্দ নেয়। এতে আমাদের মতো ছোট ঠিকাদাররা চাইলেও বিপণন কোম্পানিগুলো থেকে বিটুমিন নিতে পারি না। তাই বাধ্য হয়ে সিন্ডিকেট সদস্যদের কাছ থেকেই বেশি দামে বিটুমিন কিনি। একেক ড্রামে সরকারি দরের চেয়ে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত বেশি দিতে হয়।
বিটুমিনের দাম নির্ধারণের বিষয়ে বিপিসির পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা) সৈয়দ মেহদী হাসান আজাদীকে বলেন, এ বছরের শুরুতে বিটুমিনের দাম একবার কমানো হয়েছিল। এখন চাহিদা বাড়তি থাকলেও দাম বাড়ানোর কোনো সিদ্ধান্ত নেই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসরকারের গম নিয়ে চার দিন ধরে বসে আছে জাহাজ
পরবর্তী নিবন্ধ১২-১৭ বছর বয়সীদের ফাইজারের টিকা দেবে সরকার