মোসতাক খন্দকার : আবৃত্তি যার আরাধ্য বিষয়

শুভ্রা চক্রবর্তী | মঙ্গলবার , ২১ মার্চ, ২০২৩ at ৫:০৬ পূর্বাহ্ণ

আবৃত্তি ও কবিতাপ্রেমিক প্রিয় পাঠক, আজ যে মানুষটিকে উপস্থাপন করছি তার নাম বলার আগে ১৯৯৭ সালে ১০ অক্টোবর দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত ডা. আবু সাঈদ শিমুলের লিখা ‘চট্টগ্রামে আবৃত্তি’ শিরোনামে একটি তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধে তার আবৃত্তি চর্চার একক ও সাংগঠনিক কর্মযজ্ঞ সম্পর্কে মূল্যায়নধর্মী কিছু কথা উদ্ধৃত করছি। এই প্রবন্ধে বলা হয় — ‘‘১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম কলেজ কেন্টিনে ২৯ জন আবৃত্তি প্রেমীকে নিয়ে মোসতাক খন্দকারের প্রশিক্ষণ কর্মশালাটি আমরা আপাতত প্রথম আবৃত্তি কর্মশালা বলতে পারি। বর্তমানে চট্টগ্রামে বেশ কয়েকজন ভাল আবৃত্তির প্রশিক্ষক আছেন, এদের মধ্যে উল্ল্লেখযোগ্য হলেন, রণজিৎ রক্ষিত, .কে.এম আসাদুজ্জামান, মাহবুব হাসান, সহিদুর রহমান, শান্তনু বিশ্বাস এবং অধুনা মোসতাক খন্দকার। ……… সবচেয়ে সম্ভাবনা নিয়ে আবির্ভূত হন মোসতাক খন্দকার। আবৃত্তি বোধে, ধারণের ক্ষমতায় তিনি এ অঞ্চলের বর্তমান আবৃত্তিকারদের চেয়ে অনেক এগিয়ে।”

আবৃত্তি অঙ্গনে শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারিত একটি নন্দিত নাম মোসতাক খন্দকার। এই নামের দীপ্তি চট্টগ্রাম, ঢাকা ছাড়িয়ে কোলকাতায় পৌছে গেছে অনেক আগেই। আবৃত্তিকলার শিল্পী ও শিক্ষক মোসতাক খন্দকার ১৯৬৩ সালের আজকের এই দিনে অর্থাৎ ২১ মার্চ চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার রাজাপুকুর লেনে জন্মগ্রহণ করেন। তার গ্রামের বাড়ি পটিয়ার ছনহরা ইউনিয়নের আলমদারপাড়ায়। মা মরহুম হাজেরা খাতুন। বাবা মরহুম খন্দকার মনির আহমদ।

আন্দরকিল্লায় বাবার ছিল ন্যাশনাল লাইব্রেরী নামে স্বনামধন্য পুস্তক বিপণী। আন্দরকিল্লার এই বিখ্যাত ন্যশনাল লাইব্রেরীতে আড্ডা ছিল আবুল ফজল, অন্নদাশংকর রায়, আশুতোষ চৌধুরী, মাহবুবুল আলম, ওহীদুল আলম, আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার, পূর্ণেন্দু দস্তিদার প্রমুখ প্রখ্যাত মনীষীদের। এমন একটি পারিবারিক বলয়ে বড় হয়ে ওঠা মোসতাক খন্দকার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে নিজেকে সাংবাদিকতা পেশায় সম্পৃক্ত করার সুযোগ পান। ১৫ বছর সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত থেকে এখন দেশের একটি স্বনামধন্য বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী পরিচালক হিসাবে কর্মরত আছেন।

আবৃত্তি একটি আলাদা বিষয় হতে পারে, এটিও একটি শিল্পের নাম এই কথাগুলো উপলব্ধি করার মত পরিপক্ক বোধ হওয়ার আগেই কবিতা এবং আবৃত্তি তার রক্তে ও মজ্জায় মিশে গিয়েছিল। সুন্দর করে কথা বলা এবং শুদ্ধ উচ্চারণের জন্যে স্কুলের বাংলার শিক্ষকগণ ক্লাসে যে কোন গদ্য ও কবিতা পড়ানোর আগে মোসতাক খন্দকারকে পাঠ করতে দিতেন। তার আবৃত্তিকার হয়ে ওঠার প্রেরণার উৎস ওই শ্রেণিকক্ষ।

আবৃত্তি মোসতাক খন্দকারের আরাধ্য বিষয়, আবৃত্তিকে ভালবেসে ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারী প্রতিষ্ঠা করেন আবৃত্তি সংগঠন ক্বণন শুদ্ধতম আবৃত্তি অঙ্গন। আর আবৃত্তির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ওইদিনই মোসতাক খন্দকার একক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চট্টগ্রাম কলেজ কেন্টিনে ২৯ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু করেন আবৃত্তি কর্মশালা। যা চট্টগ্রামের প্রথম আবৃত্তি কর্মশালার মর্যাদায় ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে। চট্টগ্রামের এই পথিকৃৎ আবৃত্তি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তা ও প্রধান প্রশিক্ষক এবং বর্তমান সভাপতি মোসতাক খন্দকার। তিনি চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমীরও আবৃত্তি প্রশিক্ষক ছিলেন। মোসতাক খন্দকার দৃষ্টি আবৃত্তি সংগঠনেরও আবৃত্তি প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। তার গ্রন্থনা ও নির্দেশনায় দৃষ্টি ৩টি বৃন্দ আবৃত্তি প্রযোজনা মঞ্চায়ন করে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের উপর ১৯৯৪ সালের ২৫ আগস্ট মোসতাক খন্দকারের গ্রন্থনা ও নির্দেশনায় ‘মহাকাব্যের মহানায়ক’ বৃন্দ প্রযোজনাটি বিপুলভাবে দর্শকশ্রোতানন্দিত হয়। জাতির জনকের মৃত্যুর পর চট্টগ্রামে এটা ছিল তাঁকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রযোজনা। সুদীর্ঘ ৩৭ বছর তিনি আবৃত্তি প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছেন। এই ৩৭ বছরে মোসতাক খন্দকার চার সহস্রাধিক শিক্ষার্থীকে আবৃত্তি প্রশিক্ষণ প্রদান করেছেন এবং তার তত্ত্বাবধানে ৭৩টি কর্মশালা সম্পন্ন হয়েছে। তার গ্রন্থনা ও নির্দেশনায় ৬৪টি বৃন্দ প্রযোজনার শতাধিক মঞ্চায়ন হয়েছে। মোসতাক খন্দকারের আবৃত্তির দু’টি একক এবং তিনটি যৌথ অডিও এ্যালবাম রয়েছে। এ ছাড়াও এই আবৃত্তি শিল্পীর গড়ংঃধয়ঁব কযধহফড়শধৎ নামে ইউটিউব চ্যানেলের আবৃত্তিগুলো ভীষণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

তার সম্পাদিত ‘কবিতা চট্টগ্রাম’ গ্রন্থটি সুধীমহলে সমাদৃত হয়েছে। এ ছাড়াও তিনি চট্টগ্রামের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ও বহুলপঠিত লিটল ম্যাগাজিন ও স্মারকগ্রন্থ সম্পাদনার সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছড়া ও কবিতা লিখতেন, লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনার সাথে যুক্ত ছিলেন এবং বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক খ্যাতিমান সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন। যা কয়েকটি গ্রন্থ আকারে প্রকাশের দাবী রাখে। সাংবাদিকতা পেশায় থাকাকালে একুশে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিকভাবে ‘মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে উদযাপন করতে জাতিসংঘের স্বীকৃতি এবং এর নেপথ্য ইতিহাস নিয়ে ২০০০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী দৈনিক আজাদীতে শীর্ষ সংবাদ হিসাবে প্রকাশিত রিপোর্টটি সর্বমহলে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে। এ বিষয়ে বাংলাদেশে প্রথম রিপোর্ট এবং প্রকাশ করার কৃতিত্ব মোসতাক খন্দকার এবং দৈনিক আজাদীর। ৩৭ বছর আবৃত্তির নিমগ্ন চর্চায় ও নিবিষ্ট সাধনায় মোসতাক খন্দকার আবৃত্তি নিয়ে একাডেমিক কথা বলার এবং লিখার অথরিটিতে পরিণত হয়েছেন। গত দুই যুগ কেবল আবৃত্তি নিয়েই লেখালেখি করেছেন। ‘আবৃত্তি তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক পাঠ’ নামে মোসতাক খন্দকারের আবৃত্তি বিষয়ক একটা গ্রন্থ রয়েছে। চট্টগ্রামে কারো কারো সম্পাদিত এবং ছোটদের গ্রন্থ প্রকাশিত হলেও মোসতাক খন্দকারের এই বইটি বড়দের জন্যে চট্টগ্রামের কোন আবৃত্তি শিল্পীর লেখা প্রথম মৌলিক গ্রন্থ। এই বইটি আমাদের দেশে এবং কোলকাতায় আবৃত্তির সু্কলিং ও কর্মশালায় এবং আবৃত্তির গবেষণায় একাডেমিক গ্রাহ্যতা পেয়েছে। ২০২২ সালে কোলকাতার বইমেলায় কোলকাতার প্রসিদ্ধ দে’জ পাবলিশিং প্রকাশ করেছে দেশবরেণ্য আবৃত্তি শিল্পী মোসতাক খন্দকার এবং কোলকাতার খ্যাতিমান বাচিক শিল্পী কাজল সুরের সম্পাদনায় ‘দুই বাংলার আবৃত্তির কবিতা’।

সদালাপী, ভদ্রজন, একজন সমৃদ্ধ বোধসম্পন্ন আপাদমস্তক কবিতাপাগল আবৃত্তিব্যক্তিত্ব এবং শিল্পের শিক্ষক ও শিল্পীর গুরু হিসেবে মোসতাক খন্দকারকে অগণিত আবৃত্তি শিল্পী ও শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখেন।

লেখক: আবৃত্তি ও সংগীত শিল্পী

পূর্ববর্তী নিবন্ধটুঙ্গিপাড়ার খোকা- আমাদের বঙ্গবন্ধু
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু ও ইতিহাসের পাতায় অগ্নিঝরা মার্চ