মোবাইল নয়, বই হোক নিত্যসঙ্গী

বইমেলায় পেশাজীবী সমাবেশে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেককে মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের দাবি

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৬:৩২ পূর্বাহ্ণ

মোবাইল নয়, বইকে নিত্যসঙ্গী করার আহ্বান জানিয়েছেন দৈনিক আজাদীকে সম্পাদক এম এ মালেক। তিনি বলেন, আমাদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। বই জানার এবং জ্ঞানের শক্তি অনেক বেশি বাড়িয়ে দেয়। আমরা যত বেশ পড়ব তত বেশি জ্ঞানী হব। যত বই পড়ব তত ভালো কিছু চিন্তা করার শক্তি অর্জিত হবে। বই কখনো মিথ্যা বলে না। প্রতিটি বইয়ে কোনো না কোনো ভালো মেসেজ থাকে। তাই স্লোগান হোক, মোবাইল নয়, বই হোক নিত্য সঙ্গী।

গতকাল অমর একুশে বইমেলার আলোচনা মঞ্চে অনুষ্ঠিত ‘একুশের চেতনায় পেশাজীবীদের ভূমিকা’ শীর্ষক পেশাজীবী সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। সমাবেশে পেশাজীবী নেতৃবৃন্দ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেককে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক এবং একুশে পদক প্রদানের দাবি জানান। তৎকালীন পাকিস্তানি সরকারের চোখে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আসবে জেনেও মাথা নত না করে একুশের প্রথম কবিতা ছাপানোর জন্য পদক দেয়ার জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।

পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের সভাপতি প্রফেসর ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে প্রধান বক্তা ছিলেন সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রিয়াজ হায়দার চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির নবনির্বাচিত সভাপতি অধ্যাপক মো. মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী। বক্তব্য রাখেন চসিকের ৮ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মোরশেদ আলম, জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এ এইচ এম জিয়া উদ্দিন, বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবু তাহের চৌধুরী, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক দেবদুলাল ভৌমিক, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক এস এম শহীদুল আলম, বাংলানিউজ টুয়েন্টি ফোর ডটকমের ডেপুটি এডিটর তপন চক্রবর্তী, চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বাবু, প্রফেসর ড. ইদ্রিস আলী, পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের অর্থ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মেজবাহ উদ্দীন, নারীনেত্রী অ্যাডভোকেট রেহেনা বেগম রানু ও আবৃত্তিশিল্পী রাশেদ হাসান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বইমেলা পরিষদের আহ্বায়ক কাউন্সিলর ড. নিছার উদ্দীন আহমেদ মঞ্জু। সঞ্চালনা করেন শাহাব উদ্দিন মজুমদার।

এম এ মালেক বলেন, আমার বাবা ১৯৫২ সালে মাহবুব উল আলম চৌধুরীর রচিত ভাষা আন্দোলনের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ ছাপিয়ে দিয়েছিলেন। আমার বাবা কিন্তু জানতেন এ কবিতা ওই সময়ে ছাপানো মানে তৎকালীন পাকিস্তানি সরকারের চোখে দেশদ্রোহিতা। জেলজুলুমের বিষয়টি মাথায় রেখেইে বাবা কবিতাটি ছাপিয়ে দিয়েছিলেন। পরদিন সেটা লালদীঘি মাঠে পঠিত হয়েছিল। সেই কবিতার প্রিন্টার্স লাইনে কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস লেখা ছিল। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, সরকারের কোনো প্রমাণের দরকার হয়নি। যখন রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে মামলা হলো তখন আমাদের ম্যানেজার দবিরকে জেলে নিয়ে গেল পুলিশ। ছয় মাস জেল খাটার পর যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এলে উনাকে জেল থেকে ছেড়ে দেয়া হয়।

উপস্থিত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমরা অনেক সময় বলি ‘ইম্পসিবল’ (অসম্ভব)। বিশ্বাস কর, বর্তমান বিশ্বে ইম্পসিবল বলে কোনো শব্দ নেই। সবকিছুই ‘পসিবল’ (সম্ভব)। যদি সেটাকে আমরা ঠিকভাবে চিন্তা করতে পারি, সলভ করতে পারি। ইম্পসিবল শব্দকে যদি ভাগ করে পড়ি তাহলে হবে ‘আই অ্যাম পসিবল’। জীবনে কিন্তু আমাদের স্বপ্ন দেখতে হবে। এপিজে আবদুল কালামের ‘স্বপ্ন সেটা নয় যেটা তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখো। স্বপ্ন হলো সেটাই যা পূরণের অদম্য ইচ্ছা তোমায় ঘুমোতে দেবে না।’ উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, জীবনকে কিভাবে সাজাব তার স্বপ্ন দেখতে হবে। সেটা ঘুমের মধ্যে না দেখে দিনের মধ্যে দেখতে হবে। তবেই সে স্বপ্নপূরণ হবে।

আজাদী সম্পাদক বলেন, ওস্তাদ রবি শংকর একজন ভক্তকে দেয়া অটোগ্রাফে লিখেন ‘তোমরা বড় হইও না। যদি বড় হও তাহলে আজ নিষ্কলুষ যে চরিত্রের অধিকারী আছ সেই চরিত্র তোমরা হারাইও না।’ কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, চারপাশে যেভাবে চলছে তাতে চরিত্র নিষ্কলুষভাবে রাখতে পারছি না। তিনি বলেন, সমাজকে আমাদের গড়ে তুলতে হবে, রাষ্ট্রকে গড়ে তুলকে হবে, চারিত্রিক যে দুর্বলতা আছে সেগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে। তা না হলে আমাদের দেশ এগিয়ে যাবে না।

ডা. একিউএম সিরাজুল ইসলাম বলেন, পেশাজীবীদের সৎ, দেশপ্রেমিক এবং অসাম্প্রদায়িক হতে হবে। তাহলেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। তিনি বলেন, একুশের প্রথম কবিতার কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীকে অনেক পরে একুশে পদক দেয়া হয়েছিল। ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেককে এখনো দেয়া হয়নি। আজকের মঞ্চ থেকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে দাবি করছি তাকে স্বাধীনতা পদক দেয়া হোক। আমরা চট্টগ্রামবাসী প্রস্তাব করব, বিলম্বে হলেও তাকে যেন সম্মানিত করা হয়। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম নানাভাবে নিগৃহীত। কিন্তু চট্টগ্রামে গৌরবের অনেক কিছু আছে। চট্টগ্রাম থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল এবং চট্টগ্রাম থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র বের হয়।

রিয়াজ হায়দার চৌধুরী বলেন, ঝুঁকি থাকলেও সাহস করে কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে একুশের প্রথম কবিতা ছাপিয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেক। এই কবিতার কবিকে দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক পরে এসে মরণোত্তর একুশে পদক দেয়া হয়। ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেককে মরণোত্তর একুশে পদক দেয়ার দাবি জানাই। এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র দায়মুক্ত হবে, সম্মানিত হবে।

প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী বলেন, শিক্ষিতঅশিক্ষিত সবাই নির্বিচারে বিয়ের নিমন্ত্রণপত্রে ইংরেজি লিখে। কিন্তু ইংরেজিতে লিখলে আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি করে কিনা বা বাংলায় লিখলে আত্মমর্যাদা কমায় কিনা বুঝতে পারি না। আমার কাছে মনে হয়, বক্তব্যে যা বলি তা ব্যক্তিজীবনে প্রতিফলন ঘটায় না। আমাদের দ্বৈত এই আচরণই সর্বত্র বাংলা প্রতিষ্ঠার বড় প্রতিবন্ধকতা।

কাউন্সিলর মো. মোরশেদ আলম বলেন, অনেক রক্তের বিনিময়ে পাওয়া ভাষাকে বিকৃত করা হচ্ছেএটা দুঃখজনক। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া বাংলা ভাষা যেন কলুষিত না হয়।

মেলার চিত্র : ছুটির দিন হওয়ায় গতকালও মেলায় পাঠক, লেখক ও দর্শনার্থীর ভিড় ছিল। বিকিকিনিও ভালো হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকাশকরা। গতকাল মেলায় আসা নতুন বইগুলোর মধ্যে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে খন রঞ্জন রায়ের ‘গ্রাম ও প্রেম’, জামাল উদ্দিনের ‘রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস’, নির্ঝর নৈঃশব্দের ‘আরজ আলী আলোআঁধারির পরিব্রাজক’ এবং আবু মোশাররফ রাসেলের ‘মায়াভবন’। মায়াভবনের ভূমিকায় লেখা হয়, উত্তম পুরুষে লেখা মায়াভবনের গল্পে তুলে ধরেন মানবনের নানা চড়াইউৎড়াই আর অমোঘ বাস্তবতা। সাংবাদিকের অনুসন্ধানী চোখে তিনি পরখ করেন জগৎ সংসার, মানুষ এবং সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকা রহস্যসূত্রগুলোকে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গোপসাগরে এক রাতে চার ট্রলারে ডাকাতি
পরবর্তী নিবন্ধবিশ্বকে বদলে দেবে চ্যাটজিপিটি