প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমদের ইন্তেকালে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, সংসদ সদস্য মোছলেম উদ্দিন আহমদ আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ছিলেন।
তিনি বলেন, মানুষ মরণশীল একদিন সবাইকেই চলে যেতে হবে, তবে তার কর্মফলকেই মানুষ স্মরণ করে। মোছলেম উদ্দিন সাহেব আমাদের দল এবং দেশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ছিলেন। তাকে জাতি চিরদিন স্মরণ করবে।একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য মোছলেম উদ্দিন আহমদের মৃত্যুতে জাতীয় সংসদে আনীত শোক প্রস্তাবের উপর আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী গতকাল সোমবার একাদশ জাতীয় সংসদের ২১তম ও ২০২৩ সালের প্রথম অধিবেশনের ২৩তম কার্যদিবসে এ শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। পরে শোক প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত হয়। খবর বাসসের।
শোক প্রস্তাবের উপর আলোচনায় অংশ নিয়ে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মোছলেম উদ্দিন আহমদ ছাত্র জীবন থেকে রাজনীতি করে উঠে এসেছেন। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে কখনো তার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এবং তার পূর্বের আন্দোলনে চট্টগ্রামে তিনি সবসময় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি একটি অপারেশন চালানোর সময় মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ গ্রেপ্তার হন। সেখানে তিনি যথাযথ গেরিলার মতোই কাজ করেছিলেন এবং সেখান থেকে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হন। মুক্ত হয়ে তিনি আবারও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এর মাধ্যমে দেশপ্রেম এবং দেশের জনগণের জন্য যে কর্তব্যবোধ সেটাই প্রকাশিত হয়।
তিনি বলেন, ১৯৭৫ সাল আমাদের জন্য একটি কলঙ্কময় অধ্যায়। মহিউদ্দিন চৌধুরী, মৌলভী সৈয়দসহ যারা সেদিন প্রতিবাদ করেছিলেন, মোছলেম উদ্দিন তাদের সাথেই ছিলেন, তারা সেদিন সকলে মিলে প্রতিবাদ করেছিলেন। ওই সময় মৌলভী সৈয়দকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাকে দিনের পর দিন টর্চার করে জিয়াউর রহমান তাকে হত্যা করে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনসহ আমাদের প্রত্যেকটি আন্দোলন সংগ্রামে তিনি সক্রিয় ছিলেন। খালেদা জিয়া যে ভোট চুরি করেছিল, তার বিরুদ্ধে আমরা যে, ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করেছিলাম, সেই আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। আমাদের প্রতিটি আন্দোলনে তার উপস্থিতি আমরা উপলব্দি করেছি। লালদিঘির ময়দানে মিটিং করতে গেলে সেখানে আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করা হয়েছিল, একবার না–দুই/তিনবার আমি গুলির মুখোমুখি হই। মোছলেম উদ্দিন ভাইকে সব সময় পাশে পেয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৭ সালে আমাকে দেশে আসতে বাধা দেয়া হয়েছিল। ওই সময় আমাদের নেতাকর্মীদের উপর অকথ্য অত্যাচার–নির্যাতন হয়েছিল। তারপরও তিনি সক্রিয় ছিলেন, পিছু হটেননি। আওয়ামী লীগের নিবেদিত প্রাণ একজন কর্মীকে আমরা হারিয়েছি। তিনি আমাদের প্রতিটি দুঃসময়ে দলের পাশে যেমন ছিলেন, জাতীয় স্বার্থেও তিনি যথেষ্ট অবদান রেখে গেছেন। ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন, কিন্তু তার সেই কষ্টের কথা তিনি ভুলে গেলেন, যখন চট্টগ্রামে জনসভা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেই জনসভা আয়োজন করতে দিন–রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। ওই সময় তার একটা কেমো নেয়ার তারিখ ছিল। সেটাও তিনি নেননি, মনে করেছিলেন–মিটিংটা শেষ হবার পরই তিনি তা নেবেন। এই যে একটা আন্তরিকতা বা দলের প্রতি কর্তব্যবোধ, দেশের মানুষের প্রতি তার যে দায়িত্ববোধ সেটাই ছিল সব চাইতে বড় কথা।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা তাকে মনোনয়ন দেয়ার জন্য অনেকবারই চেষ্টা করেছি। দু’বার নমিনেশন দেয়ার পরও তিনি তখন জয়ী হতে পারেননি। পরে ২০২০ সালে মনোনয়ন দেয়ার পর তিনি জয়ী হয়ে আসেন। তিনি সংসদ সদস্য হয়ে আশায় খুবই খুশী ছিলেন যে, সংসদে তিনি তার জনগণের কথা বলতে পারবেন এই ভেবে। কিন্তু আজ তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন। আওয়ামী লীগের জন্য এটা একটা বিরাট ক্ষতি। কারণ ছোট বেলা থেকে চট্টগ্রামের সাথে আমাদের যোগাযোগ। চট্টগ্রামের বহু নেতা একে একে চলে গেছেন। করোনার সময় অনেককে আমরা হারিয়েছি। আওয়ামী লীগের ২১ জন সংসদ সদস্যকে হারিয়েছি, আর জাতীয় পার্টির দুইজন। এছাড়া ধর্মমন্ত্রী আব্দুল্লাহ সাহেবকেও আমরা হারিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী তার শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান।
সরকারি দলের সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, মোছলেম উদ্দিন আহমদ সকল আন্দোলন সংগ্রামে সামনে থাকতেন কখনো তিনি পিছ পা হতেন না। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মরহুম মহিউদ্দিন আহমদের সাথে চট্টগ্রামে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরে তিনি আবারো মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। সংগঠনের কাজে সে কখনো গাফিলতি করেনি। তিনি জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত দলের জন্য নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করেছেন। আমরা ইতোমধ্যে মহিউদ্দিন চৌধুরী, আখতারুজ্জামান চৌধুরীসহ অনেক নেতাকে হারিয়েছি। তাকে হারানোর মধ্য দিয়ে দলের প্রথম কাতারের আরও একজন নেতাকে আমরা হারালাম।
আলোচনায় অংশ নিয়ে তথ্য ও সমপ্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, মোছলেম উদ্দিন আহমদ ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার পরও কখনো বসে থাকেননি। দলের কাজ বা সংসদের কাজে সবকিছুতে সব সময় তিনি অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ সভাপতির একটি ঐতিহাসিক জনসভা হয়েছে। সেই জনসভা আয়োজন করার জন্য তিনি যেভাবে দিনের পর দিন খেটেছেন, একজন সুস্থ মানুষও সেভাবে কাজ করতে পারে না।
তথ্য ও সমপ্রচার মন্ত্রী বলেন, মোছলেম উদ্দিন আহমদ এমন একজন নেতা ছিলেন যিনি কর্মী থেকে নেতা হয়েছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দক্ষিণ জেলা আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, পরে সভাপতি হয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে তিনি প্রথম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সাল থেকে তিনি আমৃত্যু দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে, প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে তার যে সরব পদচারণা এবং প্রত্যেকটি কর্মীর সাথে যে যোগাযোগ এটি একজন একজন তৃণমূলের নেতা যেমন হওয়া দরকার, একজন রাজনৈতিক কর্মীর যেমন হওয়া দরকার, একজন রাজনৈতিক নেতার যেমন হওয়া দরকার তিনি ঠিক তেমনই ছিলেন। ১৯৭১ সালে আমাদের প্রয়াত নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরে তারা দুইজন পাগলের অভিনয় করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাত থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ২০০৭ সালে ১/১১ পরবর্তী সময়ে আমাদের দলের অনেক নেতা যখন নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল। যখন আমাদের দলের অনেক নেতা বেসুরে কথা বলছিল, তখন মোছলেম উদ্দিন আহমেদ নেত্রীর পক্ষে দলের নেতৃত্বের পক্ষে সরব ছিলেন এবং আন্দোলন সংগ্রাম সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিলেন। তথ্যমন্ত্রী বলেন, তিনি যখন ক্যান্সার আক্রান্ত ছিলেন তখনো তিনি দলের কোনো কাজে পিছ পা হননি। তিনি না বললে তাকে দেখে বুঝার কোনো উপায় ছিল না যে, তিনি অসুস্থ। এমনই ছিলেন মোছলেম উদ্দিন আহমদ। একজন রাজনৈতিক কর্মীর এমনই হওয়া উচিত। দলের দুঃসময়ে আন্দোলন সংগ্রামের বাঁকে বাঁকে প্রয়োজনের মুহুর্তে কেমন ভূমিকা রাখা উচিত, মোছলেম উদ্দিনের কাছ থেকে দলের নেতাকর্মীদের অনেক কিছু শেখার আছে। তিনি তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন।
জাতীয় পার্টির সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, মোছলেম উদ্দিন আহমদকে আমি ছাত্র জীবন থেকে চিনি। তিনি এতো ভাল লোক ছিলেন যে, তিনি সব সময় মানুষের উপকার করতে চাইতেন। তার মধ্যে ধৈর্য্য ছিল অসামান্য। তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও রাজনীতির প্রতি অবিচল আস্থা ছিল এবং এটা মেনেই তিনি কাজ করেছেন।
সরকারি দলের সদস্য শাজাহান খান বলেন, মোছলেম উদ্দিন আহমদকে আমি যতদিন থেকে চিনি এবং জানি, তিনি ছিলেন একজন ভদ্রলোক এবং দলের প্রতি ছিল তার অবিচল আস্থা। তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। এলাকার নেতাকর্মীদের সাথে তার ছিল এক নিবিড় সম্পর্ক।
জাতীয় পার্টির সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ৬০–এর দশক থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোছলেম উদ্দিন আহমদ ছিলেন আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি অত্যন্ত শান্ত, ধীরস্থির ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে আমরা একসাথে কাজ করেছি। জাতীয় পার্টির মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, মোছলেন উদ্দিন আহমদ দলের এবং দলের নেত্রীর প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে আজীবন দলের দায়িত্ব পালন করেছেন। আলোচনায় আরও অংশ নেন–হুইপ সামশুল হক চৌধুরী ও হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন।
মোছলেম উদ্দিন আহমদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন ও তার আত্মার শান্তি কামনা করে সংসদে মোনাজাত করা হয়। মোনাজাত পরিচালনা করেন তরিকত ফেডারেশনের সদস্য সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী।












