মে দিবসের চেতনা ও ইসলামে শ্রমের মর্যাদা

অধ্যাপক কাজী সামশুর রহমান | শনিবার , ১ মে, ২০২১ at ৭:৫৩ পূর্বাহ্ণ

মহান মে দিবসটিকে মেহনতি শ্রমজীবী মানুষ নিজেদের সংগ্রামের মাধ্যমে বিজয় দিবস হিসেবে দেখে। ১৮৮৬ সালে শিকাগো শহরের হে মার্কেটে পরপর দু’দিনের ঘটনায় ১১জন শ্রমিকের আত্মদান ও আলবার্ট পারসনস, অগস্ট স্টাইজ, এডলফ ফিসার ও জর্জ এঙ্গেলস’র মতো বীর নেতাদের ফাঁসি কাষ্ঠে ঝোলানোর মধ্য দিয়ে শ্রমজীবী মানুষের দৈনিক ৮ ঘন্টা কর্মঘন্টা স্বীকৃতি পায়। তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বিশ্বের কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ ৮ ঘন্টা কাজ করার সুযোগ পায়। অবশ্য উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে এর চেয়েও কম কর্মঘন্টা কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশে শ্রমিকদের নিয়ে গৃহীত সরকারি পদক্ষেপসমূহ আইএলও প্রতিনিধি পর্যবেক্ষণ করেন। যিনি শ্রমিক নেতা হবেন তার ট্রেড সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। মালিকপক্ষ ফাঁকি দিচ্ছেন, না কি দাবী দাওয়া পুরণে অসমর্থ সে সম্পর্কেও নেতাদের জানতে হবে। সর্বোপরি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আইন কানুন, মানবিক মূল্যবোধসহ দেশপ্রেম ধারণ করা অবশ্যই জরুরি। শ্রমিকদের কথায় ভর করে হঠাৎ কিছু করে ফেলা এটা শ্রমিক, মালিক ও দেশের স্বার্থপরিপন্থী হতে পারে। উৎপাদন বন্ধ হলে শ্রমিক মালিক রাষ্ট্র সমাজ সকলেরই অপূরণীয় ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে। আমার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি মাথাভারি প্রশাসন অযোগ্য ও অসৎ আমলা-কর্মচারী এবং কূটকৌশল অবলম্বনকারী অসাধু শ্রমিক নেতা ও মালিক পক্ষ শ্রমিক অসন্তোষ ও অরাজকতার জন্য অনেকাংশে দায়ী।
মনে রাখা প্রয়োজন ১৬ কোটি মানুষের দেশ আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ। শ্রমিক আর মালিক আমলা কামলা প্রত্যেকেরই দেশ। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি প্রত্যেকেরই দায়-দায়িত্ব আছে। উৎপাদন হলে আয় হবে, আয় হলে অর্থনীতি সচল থাকবে, অর্থনীতির গতিশীলতা বৃদ্ধি হলে সামষ্ঠিক অর্থনৈতিক অবস্থা চাঙ্গা হবে, জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধি হবে জীবন ধারনের স্বাচ্ছন্দ্য আসবে। এ দেশে মিল কল কারখানা লোকসান হওয়ার কোন কারণ নেই, সততা, নিষ্ঠা, দক্ষতা ও দেশপ্রেমিক যোগ্যতা সম্পন্ন পরিচালক/নেতৃত্ব যেখানে রয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানে লোকসান হয় না বা হবে না। লোকসানের মূল কারণ শ্রমিক নয়, অযোগ্য ও মাথাভারি প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা ও দায়িত্বহীনতাই অনেকাংশে দায়ী।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বিধিবিধান যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে মোটেই সম্ভব নয়। তবে ন্যূনতম চাহিদা পূরণে (অর্থনীতির ভাষায় যাকে বলা হয় গরহরহসঁস ংঁনংরংঃবহপব ষবাবষ) মালিক পক্ষকে সতর্ক থাকতে হবে। অনেক শিল্প মালিক উদ্যোক্তাদের মধ্যে ব্যাংক লোন আত্মসাৎ করা, বিভিন্নভাবে ফাঁকি দেয়ার প্রবণতাই লোকসানের অন্যতম একটি কারণ। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো এ দেশে ব্যবসা করে হাজার হাজার কোটি টাকা স্বদেশে নিয়ে যাচ্ছে। আর এ দেশীয় শিল্প মালিকরা দেনাগ্রস্ত হয়ে খেলাফী হচ্ছে, এটা কি মানা যায়?
শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘণ্টা শ্রমঘণ্টা আদায় করতে গিয়ে যারা প্রাণ দিয়েছেন, তাদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। আজ শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বহুবিধ রক্ষাকবচ প্রদান করা হয়েছে। এ সবের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন সময়ের দাবি। সকল পক্ষ সততা ও যোগ্যতার অধিকারি হতে পারলে এ দেশের শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে এবং এতে করে সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন তরান্বিত হবে। মহান মে দিবসে আমাদের শপথ হোক নিজে সৎ হবো, অপরকেও সৎ হতে সাহায্য করবো, সততার সাথে শ্রম বিনিয়োগ করবো ন্যায্য প্রাপ্য পাওয়ার নিশ্চয়তা দাবি করবো। মেহনতী মানুষের জয় হোক।
শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা রক্ষায় ইসলাম কী বলে?
১৬৮৪ সালে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে প্রথম ঠেলাগাড়ি চালকদের একটি সংগঠনের গোড়াপত্তন হয় আমেরিকায়। তখনো সে দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়নি। তারও এক হাজার বছর পূর্বে বিশ্বনবী রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম শ্রমিকদের অধিকার মর্যাদা ও প্রাপ্যতা নিয়ে এক অবিস্মরণীয় ও সর্বোৎকৃষ্ট নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে।
মহানবী ইরশাদ করেন, ‘‘শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকানোর পূর্বে তার পারিশ্রমিক প্রদান কর, সাধ্যাতীত বোঝা তার উপর চাপিয়ে দিয়ো না, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অধিকার, ধনী-গরীব, রাজা, প্রজা, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য সমান এবং দাস বেচা-কেনা অবৈধ ঘোষণা করা হলো চিরতরের জন্য। এক কাজের নিয়োগ দিয়ে অন্য কাজ করানো, হাল্কা কাজ করার ফাঁকে ভারি কাজ করানো অর্থাৎ প্রতারণামূলক কোন কাজ শ্রমিকদের দ্বারা করানো যাবে না। গৃহকর্তা গৃহকর্মিসহ তোমাদের অধীনস্থ সকলের ক্ষেত্রে তোমাদের নিজেদের জন্য পরিচ্ছদ ও খাবার পছন্দ করো, তেমনি তাদের জন্যও অনুরূপ পছন্দ করবে।’’ ইসলাম শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার যেভাবে মূল্যায়ন করেছে সেভাবে আধুনিক বিশ্ব চিন্তাই করতে পারে না।
আল্লাহ্‌ তা‘আলা ইরশাদ করেন, “মুমিনদের মধ্যে যারা তোমাদের অধীনস্থ তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করো।”
[সূরা শুয়ারা]
হযরত আবু যর (রা.) হতে বর্ণিত, তোমাদের অধীনস্থ ব্যক্তিরা (দাস-দাসী), চাকর-চাকরাণী তোমাদের ভাই বোন। সুতরাং যে ভাইকে ভাইয়ের অধীনে করে দিয়েছেন, সে তার ভাইকে যেন তাকে তাই-ই খাওয়ায়, যা সে নিজে খায়। তাকে পরিধান করায়, যা সে নিজে পরিধান করে।
[বোখারী শরীফ, ২য় খন্ড]
শ্রম হল মানুষের শরীরের অন্তর্নিহিত শক্তি। আল্লাহ্‌ তা‘আলার এক অফুরন্ত নিয়ামত। অবৈধ পথে এটা বিনিয়োগ করা হারাম ও কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আল্লাহ্‌ কায়িক শ্রমকে অধিক পছন্দ করেন। কেননা বৈধ (হালাল) উপার্জনে ইহা অদ্বিতীয়। সকল পয়গাম্বরগণই কায়িক শ্রম দিয়েছেন। প্রায় সকল নবীগণ ছাগল, মেষ পালন করেছেন। হযরত দাউদ আলায়হিস্‌ সালাম বর্ম তৈরী করে বিক্রি করেছেন, হযরত নূহ আলায়হিস্‌ সালাম কাঠের নৌকা তৈরি করে বিক্রি করেছেন, ভিক্ষাবৃত্তি নিরুৎসাহিত করে প্রিয় নবী কোদাল কিনে দিয়েছেন। কোন পেশাই তুচ্ছ নয়, যদি হারাম না হয়। শিল্প কল কারখানার উৎপাদনসহ যাবতীয় অবকাঠামো তৈরিতে শ্রমিকের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। বিশ্ব সভ্যতা বিনির্মাণে শ্রমিকের অবদান অনস্বীকার্য। সুতরাং শ্রমজীবী মানুষের প্রতি অন্যায় আচরণ, যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক না দেয়া ও সর্বপ্রকার প্রতারণা থেকে নিজেকে সংযত রাখা প্রত্যেক মানুষের ঈমানী-দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ কথাটা যতো তাড়াতাড়ি আমরা বুঝতে পারবো, শ্রমিকের মর্যাদার প্রতি আস্থাশীল হবো, ততো তাড়াতাড়ি আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটবে এবং মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত হবে। মে দিবসে আমাদের শপথ হোক, আমরা যেন শ্রমজীবী মানুষ তথা অধীনস্থদের প্রতি সদয় হই।
লেখক: সাবেক শ্রমিক নেতা ও মুক্তিযোদ্ধের সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘এ সংসারে কেউ না আপন জনা’
পরবর্তী নিবন্ধমেহনতি মানুষের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হবে