মেহনতি মানুষের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হবে

মে দিবস

তপন দত্ত | শনিবার , ১ মে, ২০২১ at ৭:৫৭ পূর্বাহ্ণ

১৩৫ বৎসর পূর্বে আমেরিকার শিকাগো শহরে ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে আন্দোলনরত ধর্মঘটে শ্রমিকদের উপর মালিকের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশ বাহিনী নির্মমভাবে গুলি চালিয়ে শ্রমিক হত্যা করে। পরে ৯ জন শ্রমিক নেতাকে গ্রেপ্তার করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। কিন্তু ৮ ঘণ্টার দাবিকে শেষ পর্যন্ত অস্বীকার করা যায়নি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ১৯১৯ সালে বিশ্বব্যাপী ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের স্বীকৃতি দিয়ে সংস্থার ১ম কনভেনশনটি গ্রহণ করে।
কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হলো ১৩৫তম মে দিবসের প্রাক্কালে চট্টগ্রামের গন্ডামারায় ১৭ই এপ্রিল ৭ জন শ্রমিক পুলিশের গুলিবর্ষণে নিহত হয় এবং প্রায় অর্ধশতাধিক শ্রমিক গুলিতে আহত হয়েছে- যার মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা এখনও আশংকাজনক। গন্ডামারায় নির্মাণাধীন কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শ্রমিকরা দীর্ঘদিন ধরে কয়েকটি শ্রম আইনে স্বীকৃত অধিকার আন্দোলন যেমন ৮ ঘণ্টার কর্মদিবস, পূর্ববতী মাসের মজুরি পরবর্তী মাসের ১০ তারিখের মধ্যে পরিশোধ করা যা শ্রম আইনের যথাক্রমে ১০০ ও ১২৩(১) ধারায় স্বীকৃত অধিকার। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঐ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের দৈনিক ১০/১২ ঘণ্টা কাজ করানো হয়। মজুরি ঘণ্টা হিসাবে প্রদান করা হয়। অর্থাৎ ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের আইনকে এড়িয়ে অতিরিক্ত কাজের জন্য দিগুণ ওভারটাইম ভাতা থেকে শ্রমিকদের বঞ্চিত করার জন্য এই কৌশলটি গ্রহণ করা হয়।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শ্রমিকরা দাবী করছিল অন্তত রমজান মাসে ৮ ঘণ্টার বেশি যেন কাজ করানো না হয়। এই সব দাবীর জন্য বাঁশখালীতে শ্রমিকদের প্রাণ দিতে হলো- এ যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। এই সব দাবী ছিল আইন সঙ্গত এবং অত্যন্ত প্রাথমিক পর্যায়ে। স্বাধীনতার অর্ধশতবর্ষে আর জাতির পিতার জন্মশত বার্ষিকীতে এই ধরনের ঘটনা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
বাংলাদেশে বর্তমানে শিল্প, সেবা ও কৃষি খাতে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি শ্রমিক কর্মরত। এদের শতকরা ৮৫-৮৬ ভাগ শ্রমিক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে যাদের ক্ষেত্রে শ্রম আইন কার্যকরের বালাই নেই। এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক খাতে শতকরা ১৩-১৪/ কর্মরত শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও এইসকল আইন কার্যকর করতে নিয়োগকর্তারা অনীহা প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশে এখন অনুন্নত দেশের তকমা পরিত্যাগ করে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা সনদে স্বাক্ষর করেছে।
মূলত বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের প্রেরিত ও গার্মেন্টসহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানি আয় থেকে বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার সূচিত হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে শ্রমজীবী মানুষের কাঠোর শ্রম ও মেধা প্রয়োগের ফলে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও যথেষ্ট পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাথাপিছু আয়, শিক্ষার হার, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রসার কিছু কিছু সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মকাণ্ড ইত্যাদির অগ্রগতির ফলে দেশ অনেক এগিয়ে গেছে। দরিদ্র সীমার নিচে অবস্থানকারী মানুষের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু এটাও ঠিক যে এই সব সম্পদের একটি বড় অংশ দুর্নীতি, পাচার এক শ্রেণির মানুষের অপ্রয়োজনীয় ও অতি ভোগের ফলে অভ্যন্তরীণ সম্পদ উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের কাজে নিয়োজিত হচ্ছে না।
দুর্নীতি সম্পদ পাচার করে দেশে কোটিপতির সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধির হারে বিশ্বে বাংলাদেশ ১নম্বর স্থান পেয়েছে। কিন্তু এই সব উন্নয়নের সূচকগুলো যে টেকসই নয় বিগত বৎসরে অতিমারীতে তা প্রমাণ হয়ে গেছে। যেখানে ক্রমাগত কয়েক বছর জি.ডি.পি প্রবৃদ্ধির ফলে দারিদ্র সীমার নিচে অবস্থানরত জনসংখ্যা ১২% এর নীচে নেমে এসেছিল সেখানে ১ বৎসরে অতিমারীর প্রকোপে লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্ম হারিয়ে আয় রোজগার শূন্য হয়ে পড়েছে। অনাহারে অর্ধাহারে জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ২৪% চলে গেছে।
স্বাস্থ্যব্যবস্থায় যে কত ভঙ্গুর তা প্রমাণিত হয়েছে এক বৎসরের অতিমারীর কালে। এই সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত শ্রমিকরা জীবন বাজি রেখে গার্মেন্টস, শিপ ব্রেকিং, চা শিল্প, রি রোলিং মিল, ওষুধ শিল্প, ই.পি.জেড বন্দর, বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা সেক্টরে কর্মরত শ্রমিকরা উৎপাদন ও সেবা অব্যাহত করলেও ৮৫/৮৬ এর অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা অধিকাংশ কর্ম হারিয়ে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছে। কারণ তাদের অধিকাংশই ‘কাজ নাই মজুরি নাই’ এই ভিত্তিতে কাজ করছে। এই সব সেক্টরের মধ্যে আছে।
বিশাল সংখ্যক পরিবহন শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট, ডেকোরেটার্স কমিউনিটি সেন্টারে কর্মরত শ্রমিকেরা পেটের দায়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও কাজ করতে চায়। কিন্তু দেশব্যাপী সংক্রমণের ভয়ে লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে কর্মবিরত রাখা হলেও এই সব দিন আনে দিন খাওয়া শ্রমিকদের পরিবার পরিজন নিয়ে কিভাবে জীবন যাপন করবে তার কোন ব্যবস্থা সরকার করেনি। সমপ্রতি ৫৭২ কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। ১ কোটি ৩৬ লক্ষ পরিবারকে প্রদানের জন্য। যাতে একজন শ্রমজীবী মানুষ পাবে আনুমানিক ৫০০ টাকা করে। এটা নিতান্তই হাস্যকর। অত্যন্ত দুঃখের ২০০০ কোটি টাকা বন্টন করা যায়নি। অর্থাৎ সকল ক্ষেত্রে একটি অব্যবস্থাপনা, বিশৃংখলা বিরাজ করছে। অতিমাত্রায় আমলা ও প্রশাসন নির্ভরতা এই সব জটিলতা সৃষ্টি করেছে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও তা কার্যকর করার জন্য দক্ষ ব্যবস্থাপনা নেই। শেষ বিচারে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষকে।
মে দিবসের ঘটনার ১৩৫ বছর গত হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে ৮ ঘণ্টা কর্ম দিবসের স্বীকৃত হয়েছে তাও শতাধিক বৎসর পূর্বে। কিন্তু আমাদের দেশে এই আইনের কার্যকারিতা নাই বললেই চলে। এছাড়া জীবন ধারনের জন্য ন্যায্য মজুরি, শোভন কাজের অধিকার, কর্মস্থলে নিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা বলয় গঠন, জাতীয় নিম্নতম মজুরি, আই এল ও কনভেনশন অনুযায়ী অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন ও সংগঠিত হওয়ার অধিকার, দর কষাকষির অধিকার দেশের প্রচলিত শ্রম আইনে থাকলেও নব্য সৃষ্ট মালিক পক্ষ বা উদ্যোক্তারা এই আইন কার্যকর করার জন্য মোটেই আগ্রহী নয়। ফলে প্রায় পৌনে দুই শত বৎসর ধরে বিশ্বব্যাপী শ্রমিক শ্রেণি লড়াই সংগ্রাম করে মে দিবসে জীবন দিয়ে যে সব অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল তা আজ প্রায় সর্বত্র অস্বীকৃত হচ্ছে। কর্পোরেট পুঁজির আগ্রাসন, লুটেরা পুজির দৌরাত্ম্য আজ শুধু শ্রমজীবী মানুষ তথা ৯৯% মানুষের ভদ্রভাবে জীবন যাপনের অধিকারকে অস্বীকার করছেনা, বিভিন্ন কায়দায় সমাজ ও রাষ্ট্রকে কলুষিত করছে। মানুষের মনকেও বিষিয়ে দিচ্ছে। শ্রমজীবী মানুষ সংগঠিত হয়ে আইন সঙ্গত আন্দোলনের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের পথকে রুদ্ধ করা হচ্ছে বিভিন্ন কায়দায়। মালিকদের হাত শুধু প্রশাসন আমলা পর্যন্ত বিস্তৃত নয়, শ্রমিক আন্দোলনেও তাদের শোষনের ধারা বজায় রাখার জন্য তাদের পছন্দমত নেতা ইউনিয়ন সৃষ্টি করছে। ফলে আজকের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সেই সংগ্রামী মেজাজ আর নাই। শ্রমিকরা অসংগঠিত। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন বহুদা বিভক্ত। ১৩৫ বছর পূর্বে যে মালিক গোষ্ঠী তাদের তাদের শোষণ নির্যাতন বজায় রাখার স্বার্থে শ্রমিক হত্যা করে, অধিকার অর্জনের লড়াইকে রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিতে চেয়েছিল এত বছর পরেও আমরা তার পুনরাবৃত্তি দেখছি। এমতাবস্থায় মে দিবসের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে মেহনতি মানুষের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হবে- এই হোক আজকের মে দিবসের শপথ।
লেখক : সভাপতি, টিউসি, চট্টগ্রাম জেলা কমিটি

পূর্ববর্তী নিবন্ধমে দিবসের চেতনা ও ইসলামে শ্রমের মর্যাদা
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে