চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ ধারায় স্থানীয় সরকার আইন গণমুখী ও জোরালো করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়- গণতান্ত্রিক সরকারের আবরণে স্থানীয় সরকারের টুটি চেপে ধরা হয়েছে। এই মুহূর্তে যদি সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক জনদুর্ভোগ লাগবে কর্তৃত্ব না থাকে, তাহলে এত ব্যয়বহুল ও জটিল নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা কী? গতকাল দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এস রহমান হলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই প্রশ্ন রাখেন।
মাহমুদুল ইসলাম বলেন, সিটি কর্পোরেশন বা মেয়র তার কর্ম পরিধি আইন দ্বারা খুব সীমিত। সেখানে ব্যাপক নির্বাচন যা প্রায় পাঁচটি সংসদ সদস্য এলাকা নিয়ে গঠিত, এই নির্বাচনের কোনো যৌক্তিকতা আছে বলে মনে হয় না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্থানীয় সরকার তথা নগর সরকার দুই প্রকারের। যেসব শহরে প্রত্যক্ষ ভোটে মেয়র নির্বাচন হয় সেখানে মেয়র একদিকে যেমন প্রধান ব্যক্তি, সাথে সাথে তিনি আবার নির্বাহী বা স্থানীয় সরকারের প্রধান হিসাবে কাজ করেন। অন্যদিকে যেসব শহরে যেখানে মেয়রের নির্বাহী ক্ষমতা নেই সেখানে মেয়র পরোক্ষ ভোটে কাউন্সিলর কর্তৃক নির্বাচিত হন। কলকাতা শহরের মেয়র নির্বাচিত কাউন্সিলরদের ভোটে নির্বাচিত হন। মেয়র অব লন্ডন ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স’ অনুযায়ী ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর উপরে অবস্থান। নিউইয়র্ক শহরের মেয়র নিউইয়র্কের পুলিশ কমিশনারসহ সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পদের নিয়োগ প্রদান করেন এবং তিনি প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত মেয়র।
মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রাম শহরে আগে ২৩টি ওয়ার্ড ছিল। আমার হাত ধরে ৪১ ওয়ার্ডের নির্বাচিত কমিশনারদেরকে ক্ষমতা প্রদান করে কর্পোরেশন গঠনের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। ১৯৮৯ সালে কর্পোরেশনের নির্বাচিত কমিশনারদের সাথে সমন্বয় করে আইন মোতাবেক চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন অর্ডিন্যান্স ১৯৮২ কার্যকর করার পদক্ষেপ গ্রহণ করি। সেই সময় কর্পোরেশনের আইন অনুযায়ী আমি নিয়োগ হওয়ার পর আমাকে রাজধানীর বাহিরে কোনো ব্যক্তিকে প্রথম প্রতিমন্ত্রীর পদে ও মর্যাদায় আসীন করা হয়। আমার হাতে প্রথম নির্বাচিত কর্পোরেশন গঠিত হয়। তখন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে তিন প্রকারের বা তিন ক্যাটাগরির কমিশনার বা কাউন্সিলর ছিল। যথা- ওয়ার্ড কমিশনার, মহিলা কমিশনার এবং অফিসিয়াল কমিশনার। এই অফিসিয়াল কমিশনারের মধ্যে ছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম ওয়াসা চেয়ারম্যান, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী, চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক, গণস্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তরের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী। পরবর্তীতে রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজারকে অফিসিয়াল কমিশনার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রতিমাসে মাসিক সভায় তাদের অংশগ্রহণ আইন অনুযায়ী বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু ১৯৯০ সালের ১২ ডিসেম্বর সরকার পরিবর্তনের পরে আমার মেয়র নিয়োগ বাতিল করা হয়। ১৯৯১ সালের মে মাসে বিএনপি নেতা মীর মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনকে মেয়র হিসেবে নিয়োগ দেয় তৎকালীন সরকার। পরবর্তীতে নির্বাচিত কমিশনার বা কাউন্সিলরদের সরকার বাতিল ঘোষণা করে। যার প্রেক্ষিতে কর্পোরেশনের মাসিক সাধারণ সভা আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যায় এবং অফিসিয়াল কমিশনারদের উপস্থিতি বাধ্যবাধকতা হারায়। ১৯৯৩ সালের শেষ দিকে চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী এই চার কর্পোরেশনের নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণার পূর্বে তৎকালীন জাতীয় সংসদে উক্ত অফিসিয়াল কমিশনার পদ সমূহ বিলুপ্ত ঘোষণা করে আইন প্রণয়ন করা হয়। ১৯৯৪ সালের ৩০ জানুয়ারি একযোগে চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী এই চার কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ঢাকায় মোহাম্মদ হানিফ এবং চট্টগ্রামে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত হন। অফিসিয়াল কমিশনার পদ না থাকার কারণে সেই সময় থেকে মেয়রের আইনগত কর্তৃত্ব নগর সমন্বয় করা তথা নগর সরকার বা সিটি গভর্মেন্টের বিলুপ্তি সাধন হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় সরকার কর্তৃক কর্পোরেশনের আইন সংশোধন হলেও অফিসিয়াল কমিশনার পদ সৃষ্টি হয়নি এবং মেয়রের পদ ঠুটো জগন্নাথে পরিণত হয়।
সিটি করপোরেশনকে কার্যকর বা মেয়রের কর্তৃত্ব বাড়াতে সিটি করপোরেশন আইন সংশোধনের আহ্বান জানিয়ে মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এ মুহূর্তে সিটি করপোরেশন আইন সংশোধন করা না গেলে স্থানীয় সরকার কমিশন গঠন অথবা চট্টগ্রাম নগর বা বৃহত্তর চট্টগ্রামের জন্য প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ের অধীনে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এ কমিটি সব প্রকল্প প্রণয়ন, যথাসময়ে বাস্তবায়ন, স্বচ্ছতাসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের নৈসর্গিক সৌন্দর্য রক্ষায় কাজ করতে পারবে।