মেট্রোরেল : পরিকল্পিত ও যানজটমুক্ত নগরী গড়ার সহায়ক

রেজাউল করিম স্বপন | শুক্রবার , ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৫:৫৯ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে দেশে অনেক ক্ষেত্রে উন্নতি লক্ষণীয়। বিশেষ করে অবকাঠামো ক্ষেত্রে উন্নয়ন চোখে পড়ার মত। এরি ধারাবাহিকতায় কয়েকমাস পর ঢাকায় চলাচল করবে মেট্রোরেল, যা কয়েক বছর আগেও ছিলো স্বপ্নের মত। চলতি বছরের ডিসেম্বরে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল শুরু হবে। সেই লক্ষ্যে ২৭/১/২০২২ ইং মেট্রোরেলের উড়ালপথের সর্বশেষ ভায়াডাক্ট সেগমেন্টটি বসানো হয় প্রেসক্লাবের সামনের ৫৮২ ও ৫৮৩ নং পিলারের উপর। এর ফলে এমআরটি -৬ এর ২০.১০ কিলোমিটার উড়াল পথের নির্মাণ কাজ শেষ হলো। এখন এই উড়ালপথের উপর বসনো হবে রেললাইন। সেই রেললাইনের উপর দিয়েই চলবে স্বপ্নের ইলেকট্রিক চালিত মেট্রোরেল। যা ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে উত্তরা হতে মতিঝিলের মধ্যে যাত্রী পরিবহন শুরু হবে। ইতিমধ্যে গত ডিসেম্বরে উত্তরা হতে আগারগাঁওয়ের মধ্যে পরীক্ষামূলক ভাবে মেট্রোরেল চলাচল শুরু হয়েছে। এই পরীক্ষামূলক রেল চলাচল করবে ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত। তবে এখনো সবকটি স্টেশনের নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। আশা করা যায় আগামী ২০২৩ এর ডিসেম্বরের মধ্যে সবকটি স্টেশনের কাজ শেষ হবে। ঢাকার কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) ২০২৪ সালের মধ্যে ঢাকায় তিনটি ও ২০৩০ সালের মধ্যে ৬টি রুটে মেট্রোরেল চালুর সুপারিশ করেছিলো। এর মধ্যে উত্তরা হতে মতিঝিল পর্যন্ত পথটির নাম এমআরটি ৬। যেটির কাজ চলমান, বাকীগুলোর কাজ এখনো শুরু হয়নি। সব কটি মেট্রোরেল চালু হলে ২০৩৫ সালে দৈনিক ১৮ লাখের বেশী যাত্রী যাতায়াত করতে পারবে। ২০৩৫ সালের মধ্যে ঢাকার ৬ টি মেট্রোরেল নির্মাণ হলে এর মোট দৈর্ঘ্য হবে ১২৯ কিলোমিটার ও এসব লাইনে মোট স্টেশন হবে ১০৪ টি।
একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫% রাস্তা থাকা দরকার। সেই তুলনায় আমাদের দেশে রাস্তার পরিমাণ অত্যন্ত কম ৭-৮%। অর্থাৎ আমাদের দেশে চাহিদার এক তৃতীয়াংশ রাস্তা আছে। শহরগুলো বিশেষ করে বিভাগীয় শহরগুলোতে এর পরিমান আরো কম। অথচ রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে বসবাসরত মানুষের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি, সেই তুলনায় রাস্তার পরিমান অনেক কম। রাজধানী ঢাকার আয়তন ৫৬৫ বর্গ মাইল ও জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ। এতো বিশাল জনসংখ্যার চলাফেরার জন্য পর্যাপ্ত রাস্তা না থাকায় দীর্ঘ যানযটে আটকা পরে মানুষের হাজার হাজার কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। তাই ঢাকার চলাচল নির্বিঘ্নে করার জন্য প্রয়োজন পাতাল রাস্তা, উড়াল রাস্তা ও মেট্রোরেল। এগুলো চালু করতে পারলেই হয়ত চলাচলে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যাবে। সেই কথা মাথায় রেখে ২০১৩ সালে শুরু হয়েছে রাজধানী ঢাকার আকাশ পথ ‘ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প’। যা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট বা সংক্ষেপে এমআরটি নামে পরিচিত। ২০১৩ সালে বিশ্বের অতি জনবহুল ঢাকা মহানগরীর ক্রমবর্ধমান যানবাহন সমস্যা ও যাতায়াতের দুঃসহ যানজট কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়, যার অধীনে প্রথমবারের মত ঢাকায় মেট্রো রেল স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, তখন মেট্রোরেলের লাইনের সংখ্যা ছিল ৩ টি। অন্যদিকে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিড কোম্পানি গঠন করা হয় ৩ জুন ২০১৩। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিড কোম্পানি গঠন করা হয় মেট্রোরেলের নির্মাণ, পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ, জরিপ, ডিজাইন ইত্যাদি কাজের জন্য। ‘সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা’ অনুযায়ী সরকার ৩টি ম্যাস রেপিড ট্রানজিড বা মেট্রো রেল প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করে। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে প্রণীত সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা অনুসারে ঢাকায় নির্মিতব্য মেট্রোরেলের লাইনের সংখ্যা ৩টি থেকে বাড়িয়ে ৬টি করা হয় এবং প্রথম পর্যায়ে নির্মাণের জন্য উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০.১ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটি লাইন ৬ কে নির্বাচন করা হয়। ২০১৬ সালের ২৬ জুন উদ্বোধনের মাধ্যমে এমআরটি লাইন-৬ এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এতে বিরতিস্থল বা স্টেশন ১৬টি ও প্রতি ঘণ্টায় যাতায়াত করবে ৬০,০০০ যাত্রী।
এমআরটি ৬ এ মোট ব্যয় হবে ২২ হাজার কোটি টাকা। এতে জাইকা দিচ্ছে ৭৫% ঋণ। অর্থাৎ ১৬ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা। আর সরকার দিচ্ছে ২৫% অর্থাৎ ৫ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। মেট্রোরেলের প্রথম ধাপ চালু হবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে উত্তরা হতে মতিঝিল পর্যন্ত। মেট্রোরেলে উত্তরা থেকে মতিঝিল যেতে সময় লাগবে ৩৮ মিনিট। এতে স্টেশন থাকবে ১৬ টি। এগুলো হলো উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, জাতীয় জাদুঘর, দোয়েল চত্বর, জাতীয় স্টেডিয়াম ও বাংলাদেশ ব্যাংক। মেট্রোরেলের প্রথম ধাপের রেল পথের ২০.১০ কিলোমিটারে প্রথম ধাপে ২৪ টি ট্রেন চলাচল করবে। ঘণ্টায় ৬০ হাজার ও দিনে ৫ লাখ যাত্রী যাতায়াত করবে। প্রতি ট্রেনে ৬টি কোচ থাকবে যা ভবিষ্যতে ৮ টিতে উন্নীত করা যাবে। প্রতিটি ট্রেনে সর্বোচ্চ ২,৩০৮ জন যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। এটি মাটি হতে ১৩ মিটার উপর দিয়ে চলাচল করবে। এর সর্বোচ্চ গতি হবে ১১০ কিলোমিটার। মোট ২৪ সেট ট্রেন (৬টি বগি করে) আনা হচ্ছে জাপান থেকে। প্রথম ধাপের প্রতিটি ট্রেনে ৬টি বগি থাকবে। মেট্রোরেলের প্রতিটি পিলারের ব্যাস দুই মিটার। মেট্রোরেলের প্রতিটি পিলারের উচ্চতা ১৩ মিটার। মেট্রোরেলে প্রতি ঘণ্টায় বিদ্যুৎ খরচ হবে ১৩.৪৭ মেগাওয়াট। এই জন্য উত্তরা, পল্লবী, তালতলা, সোনারগাঁও ও বাংলা একাডেমিতে ৫ টি উপকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। মেট্রোরেলের দ্বিতীয় ধাপ হবে ৪.৪০ কি.মি হবে। যা হোটেল সোনারগাঁও থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত হবে এবং তৃতীয় ধাপ হবে ৪.৭ কি.মি হবে। যা পল্লবী থেকে উত্তরা পর্যন্ত হবে।
শুধু ঢাকা নয় চট্টগ্রামেও মেট্রোরেল স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ অচিরেই শুরু হচ্ছে। সরকার চায় ২০২২ এর মধ্যে এই সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ হউক। এজন্য দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা (কোইকা) নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এতে ৭৭ কোটি টাকা খরচ হবে। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু ইকোনমিক জোন, কর্ণফুলীর নীচে টানেল, বে-টার্মিনাল বাস্তবায়িত হলে আগামী কয়েক বছরে চট্টগ্রাম শহরের জনসংখ্যা হবে দ্বিগুণ। তাই মেট্রোরেল প্রকল্পটি চট্টগ্রামের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রজেক্ট। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, কর্ণফুলীর দক্ষিণ প্রান্ত ও বংগবন্ধু ইকোনমিক জোনকে এর আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে।
সমীক্ষার কাজ এই বছর শেষ হলে আগামী বছর এর কাজ শুরু হতে পারে। তবে এখন সরকার চায় শহরের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা সদরঘাট, চকবাজার, বহদ্দারহাট, নিউমার্কেট এলাকায় মেট্রোরেলের কাজ শুরু করতে, তবে তা পাতাল রেলের। কারণ সরকার মনে করছে এসব গিঞ্জি এলাকায় উড়াল পথ তৈরী করার মত জায়গার অভাব রয়েছে। তবে পাতাল রেল হউক বা উড়াল রেল হউক দুটোই চট্টগ্রামবাসীর জন্য আর্শীর্বাদ। কারণ দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রামে অবস্থিত হওয়ায় এর গুরুত্ব অপরিসীম। চট্টগ্রাম পাহাড়, নদী ও সমুদ্র বেষ্টিত হওয়ায় এটি দেশের পর্যটন ও ব্যবসায়ের প্রধান স্থান। এখান থেকে সরকারের রাজস্বের সিংহভাগ আয় হয়। তাই এই শহরটিকে একটি পরিকল্পিত ও যানজট মুক্ত নগরী হিসাবে গড়ে তুলতে হলে মেট্রোরেলের কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধতৃতীয় বিভাগ ফুটবল লিগে মুক্তবিহঙ্গ ও সিটি ক্লাবের জয়