টেবিলে রাতের খাবার ঝিমোয়। প্লাস্টিকের জালি ঢাকনায় সযতনে ঢেকে আছে সিরামিক বাসন। পানির জগ, গেলাস, নুনদানি, ম্যাট সবই পরিপাটি করে রাখা। মাঝ বরাবর লাগোয়া দেয়াল। উপরের দিকটায় ঝুলে আছে দেয়াল ঘড়ি। জাহাজের হুইলের আদল। টিকটিক শব্দে পেন্ডুলাম দুলে। বিরামহীন। রাত এগারোটা বাজে। এখনো ফেরেনি কণা।
হালিমা বোধহয় কাজ শেষে খাবার গুলো ঢেকে রেখে গেছে। কণাও রেখে যেতে পারে। এখন অবধি সংসারের দায়িত্বটুকুন ঠিকঠাক পালন করার চেষ্টা করে সে। এই যেমন, কাপড় চোপড় গুছিয়ে রাখা, জানালার পর্দা, বিছানার চাদর নিয়ম করে বদলানো, খাবারের যোগান ইত্যাদি। কাজগুলো সে নিজের মতোই করে। কেউ তাকে কমান্ড করুক এটা তার পছন্দ নয়। স্বাধীনচেতা। কিছুটা ঘাড়তেড়া বলা যায়।
সাবিন ও কিছু বলে টলে না। নিজের মতো অফিসে যায় আবার সন্ধ্যে হলে বাসায় ফেরে। টেবিলে যথারীতি নাস্তা সাজানো থাকে। এ নাস্তা কণা নাকি হালিমার তৈরী? সাবিন সেটা জানেনা। বলা যায় জানার আগ্রহ ও দেখায় না।
মাথার উপর একটাই ছাদ। দুজন মানুষ। যোজন ফারাক। বিছানা আলাদা। সাবিনের বিছানাটা অবশ্য ঠিকঠাক টানটান করে গুছিয়ে রাখে কণা। কোথাও এক রত্তি ধুলো জমতে দিবেনা। এই যে ঠিকঠাক গুছিয়ে রাখা, এটা কি দায়িত্ববোধ? নাকি তার চিরচেনা পরিপাটি স্বভাবের কারণে! কে জানে?
সাবিন নিজেও কি কম দায়িত্ব পালন করে? বাজার সদায়, বাসা ভাড়া, যাবতীয় বিল সবই তার কাঁধে। কণা কি যেন করে আজকাল। বেশ উপার্জন করে বলে শুনেছে সে। নিজের উপার্জনে নিজের খরচ চালায়। সাবিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেনা। সংসারের খরচ সাবিনের। এ ঘরে ফুল কিংবা গিফটের আদান প্রদান নেই।
টেবিলের উপর মেলামাইনের ঢাকনা দেয়া কাঁচের জগ। সাবিন পানি ঢালে গেলাসে। স্পটিকের মতো জল। সাবিন গেলাস হাতে নিয়ে চোখের সামনে ধরে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। ছোট ছোট দানার মতো বাবল ভাসছে। কত স্বচ্ছ জল! অথচ জীবন তেমন নয়। সংসারে সে আর কণা কি তবে ভেসে বেড়ানো বাবল? সাবিন মুচকি হাসে।
বাদশাহী ঢংয়ের কাঁচের এই জগ কণার খুব পছন্দের। বিয়ের দ্বিতীয় দিনে নিউ মার্কেটের এক ক্রোকারিজের দোকানে কণার নজর কেড়েছিল বাহারী জগটা। ভালোবাসার জগ। কণার খুব মায়া এই জগে। রোজ নিয়ম করে ধোয়। পাতলা সুতি কাপড় দিয়ে মুছে সাজিয়ে রাখে।
সাবিনের কখনো কখনো কাঁচের জগ হতে ইচ্ছে করে। মায়া! মায়া এত অধরা কেন? দুজন দুজনের প্রতি মায়ার আবেশটা কখন যে কোন ফুৎকারে মাঝখান দিয়ে উবে গেছে কর্পূরের মতো। টেরই পেলনা কেউ। মায়াহীন এই ঘর। টেনে নেয়া সংসার।
কিন্তু সাবিনের খারাপ লাগছে কেন? এত রাতে ও কণার ঘরে না ফেরাতে তার মন উতালা শংকায় কাঁপে। কণা কি একবারও ভাবে তার কথা? কণা কি জানে? বুঝতে পারে? একলা ঘরে অফিস ফেরা একাকী একজনের মন আশংকায় কেঁপে কেঁপে ওঠে। এটা ও কি দায়িত্ববোধ? হয়তোবা। একই ছাদের নিচে দুজনের বসবাস। প্রতিবেশীর ও তো দায় থাকে!
সাবিন কি কণাকে একটা ফোন করবে? ফোনের বাটনে আঙ্গুল ঘোরাঘুরি করে সাবিনের। ফোন আর দেয়া হয়না। বারান্দায় পায়চারী করে।
আকাশে ভাসছে দ্বাদশীর চাঁদ। মেঘে চাঁদে লুকোচুরি। মেঘের ওপারে চাঁদের ঘর। সাবিনের বুকে শূন্যতা। মেঘ।
মনে মেঘ। বুকে মেঘ। মেঘের সংসার। মেঘে মেঘে বসবাস। সাবিনের ঘর কোথায়? কিংবা ঘর কোথায় কণার?
সিএনজি অটোতে একাকী যাত্রী কণা। লোহার জালি নেটে আটকানো দরোজা। দরোজার সিটকিনি ড্রাইভারের পেছনে। তার নিয়ন্ত্রণে। তবুও কোন শংকা নেই কণার মনে।
এতো রাতে একাকী একজন সুন্দরী নারী, নগরীর প্রায় ঘুমিয়ে যাওয়া রাজপথ ধরে অটোতে ঘরে ফিরছে।
বিষয়টা ভয়ের। ড্রাইভার কিংবা কণা কারোরই মনে এর কোন ছাপ নেই। তারা অপরিচিত নয়। কণা এই অটোর নিয়মিত যাত্রী। ড্রাইভারের কাছে তার এই যাত্রী আশীর্বাদ। ভাড়া পায় ডাবল। সাথে বখশিস। অটো ছুটে নগরীর হিমেল হাওয়া ভেদ করে। আবাসিকে পোঁছুতে মিনিট পাঁচেক বড়জোর।
সাবিন কি করছে কে জানে? ঘুমিয়ে গেছে হয়তো। মোবাইলের স্ক্রিনে সময় দেখে কণা। বারোটা পঁয়তাল্লিশ।
আজ একটু দেরীই করে ফেললো সে। অন্যদিন বড়জোর দশ কি সাড়ে দশ। সেজুঁতিটা যে কি! ছাড়তেই চাইছিল না। তার উপর পথের মাঝখানে লরি টরি কি যেন একটা বিকল হওয়াতে ঘন্টাখানেক যোগ হলো।
বাসায় কলিংবেল চাপলে সাবিন একরাশ বিরক্তি নিয়ে দরোজা খুলে দিবে।
তাকে কি সরি বলবে সে? দূর! সরি বলার মতো কেউ কি সাবিন! সরি নেয়ার মতো যোগ্যতা কি তার আছে?
ইতর একটা। শুধু সন্দেহ করবে। বউ স্বাধীনভাবে চলুক তাতেই যত গাত্রজ্বালা। মুখে কিছু বলবেনা। বডি ল্যাংগুইজে ঠিকই বুঝিয়ে দিবে। ভন্ড।
বাসার সামনে অটো থেকে নামে কণা। ড্রাইভারের হাতে কচকচে হাজারী নোট। কণা বাসার সিঁড়ির দিকে এগোতে এগোতে পেছন ফিরে বলে,
– ফোন দিলে চলে এসো। গাড়ি ধুয়ে মুছে রাখবে।
কলিংবেল বেজে উঠলে সাবিন স্বাভাবিকভাবেই দরোজা খুলে দেয়। কণা নিজের রুমে চলে যায়। সাবিন দরোজা লাগিয়ে তার রুমে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।
সাবিন জানে, কণা এখন এক ঘন্টা সময় নিয়ে চান করবে। তারপর কিছুক্ষন বারান্দায় সময় কাটিয়ে খাবার খাবে। এরপর হাল্কা ভলিয়ূমে রবীন্দ্র সঙ্গীত চালিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে যাবে।
ঘুমন্ত কণাকে একসময় অপ্সরীর মতো দেখাতো। সাবিন কণার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে অনেক রাত্তির পার করেছে। খয়েরি রংয়ের সিল্কের নাইটিতে কণাকে অদ্ভুত সুন্দর দেখায়। ঘুমন্ত কণার মুখ দেখতে এখন আর সাবিনের ইচ্ছে করেনা।
খুব জোরে শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে চোখ মুদে থাকে কণা। বৃষ্টির মতো জলের ধারা আছড়ে পড়ে চোখে মুখে। জলে গা ধুয়ে যায়। শরীরের বাঁক বেয়ে নেমে যায় জলের ধারা। হাল্কা লাগে।
সাবিন কি করছে এখন? নিশ্চয় শুয়ে শুয়ে এফবিতে মেয়ে ফ্রেন্ডদের ছবিতে লাইক, কমেন্টস করছে। ঘরে এত সুন্দরী বউ থাকতে কি কেউ কলিগের দিকে তাকায়? অফিসের মেয়েটা প্রিয়া না কি যেন নাম। নাক থ্যাবড়া। মঙ্গোলিয় টাইপের। না আছে চেহারা, না আছে ফিগার! অথচ তাকেই জড়িয়ে ধরলো সাবিন? কিছুতেই মন থেকে দৃশ্যটা যাচ্ছেনা।
সাবিনকে সারপ্রাইজড করবে বলে কণা কোন এক দুপুরে তার অফিসে যায়। পিয়ন ছেলেটা তখন দরোজার বাইরে ঝিমুচ্ছিল। কণা ধড়াস করে রুমে ঢুকে যায়।
কি আর সারপ্রাইজ দিবে, যা দেখলো তাতে নিজেই সারপ্রাইজড। বোবা। সাবিনের কোলের উপর বসা মেয়েটি। কণাকে এভাবে প্রত্যাশা করেনি তাদের কেউই। সাবিন হতভম্ব হয়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে।
নাহ! কণা কিছুই বলেনি। সোজা চলে আসে বাসায়। এরপর হতে আর কোন কথা বলেনি সাবিনের সাথে। সাবিন বাসায় এসে কণার হাত পা ধরে অনেকবার ক্ষমা চেয়েছে। কাকুতি মিনতি করেছে। লাভ হয়নি। কণা বদলে যায়। ধীরে ধীরে অচেনা হতে শুরু করে।
চান শেষে কণা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। আকাশজুড়ে দ্বাদশীর চাঁদ। মেঘের লুকোচুরি। বারান্দার কাছেই দেবদারুর চারা গাছ। ডাল এসে লাগে বারান্দার গ্রিলে। গ্রিলের লাগোয়া পাতা পেঁচিয়ে ঘর বেঁধেছে টুনটুনি পাখি। চাঁদের আলো পিছল খায় দেবদারুর পাতায়। বাঁধ ভেঙ্গেছে চাঁদের আলো। কণার ভেতরে সেই আলো পৌঁছায় না।
সেঁজুতির ঘরে কি কান্ডটায় না ঘটে গেল আজ। একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছিল বোধহয়। টাল সামলাতে পারেনি। একদম কণার গায়ের উপর এসে পড়লো। দুহাতে জড়িয়ে ধরলো। হাসান এভাবে আচমকা জড়িয়ে ধরবে ভাবতে পারেনি কণা। সরি টরি ও বলেনি।
সেঁজুতির ভাই হাসান। মাল্টিন্যাশনালে জব করে। কণার অবশ্য তাকে খুব একটা মন্দ লাগেনি। চালু ছেলে। পৌরুষ আছে। সাবিনের মতো ভন্ড নয়। যা বলার সরাসরি বলে।
এই যেমন আজ প্রথম পরিচয়। প্রথম দেখাতেই ঠাস করে বলে দিল,
– কণা, আপনাকে জোশ লাগছে।
আপনার চোখে সাঁতার কাটা যায়।
কণার কাছে ব্যাপারটি অবাক করার মতো ছিলনা। সে পুরুষ চিনে। তাছাড়া সে ভালো করেই জানে, তার দিকে নজর সরানো পুরুষের পক্ষে সহজ নয়। কেবল হিপোক্রেট সাবিনই তাকে পড়তে পারলোনা। সাবিন কি কোনদিন তার চোখের গভীরতা মাপতে পেরেছে?
হাসানের গায়ের রগরগে ঘ্রাণ এখনো ঘুরঘুর করছে তার চারপাশে। ইতর সাবিনটা এখন নিশ্চয় নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে।
কণা শাওয়ার অফ করে।
নাহ! সাবিনের ঘুম আসছেনা। ঘুমের ভান ধরে আছে।
সম্পর্কটা কন্টিনিউ করা কঠিন। কণার সাথে কথা বলার জো নেই। বলতে গেলেই ঝগড়া বাঁধিয়ে দেবে। কিভাবে সম্ভব?
একই ছাদের নিচে দুটো প্রাণী। দিনের পর দিন কথাহীন।স্পর্শহীন!
আজ অফিসের একাউন্টস অফিসার হানিফ সাহেব বলেই বসলো। কণাকে কার সাথে জানি দেখেছে রুপটপ রেস্তোরায়। রাতের বেলায়। কথাটা শুনে ভালোলাগেনি। কণার অনলাইন পেইজ আছে। কাপড়ের বিজনেস করছে। হয়তো কোন ব্যবসায়িক কারণে ওখানে গেছে। হানিফ আর কথা বাড়ায়নি।
সত্যিই সাবিন জানেনা, কণা অনলাইনে কিসের ব্যবসা করে। তবে ঘরের কোণে অনেকগুলো থ্রি পিচ জাতীয় কাপড় গাঁট বাঁধা আছে।
সাবিন বেশ ভালো করেই জানে, কণা তাকে সহ্য করতে পারছেনা। আবার তাকে ছাড়তে ও চাইছেনা। নিজের ইচ্ছেমতো এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। সংসারও সামলায়। সেদিন বাড়িওয়ালি বাসায় এলে কণাকে বলেছে,
– একটা বাবু নিয়ে নেন ভাবী। একাকী ঘর।
এক আধটু শোরগোল না হলে কি চলে?
কণা একটু স্মিত হেসে বলেছিল,
– আরেকটু গুছিয়ে নিই ভাবী।
সাবিন তখন পাশের রুমে। শুনেছে। হেসেছে। শারীরিকভাবে কাছে নেই তারা বহুদিন। অথচ কণা গুছিয়ে নিয়ে বাবু নিবে।
কতরকম গুছিয়ে যে সে মিথ্যে বলতে জানে!
দরোজা টোকার শব্দে সাবিন উঠে বসে। কণা!
কণা তার তোয়ালে পেঁচানো ভেজা চুল নিয়েই ঘরে ঢুকে। সাবিন ঘুম ভেঙ্গে যাবার বিরক্তির ভান করে তাকায়। কণার চোখে মুখে আশ্চর্য রকমের শীতলতা।
সাবিন ভাবে, কত সহজেই না সম্পর্ক বদলে গেল! আজ কণাকে দরোজায় টোকা দিয়ে তার ঘরে ঢুকতে হয়।
সাবিন কি তাকে বসতে বলবে? কিছু বলার আগেই কণা বলে যায়….
– কটা দিন দেশের বাইরে থাকবো। ইন্ডিয়া।
কিছু নতুন ডিজাইনের কাপড় আনতে হবে।
কালই যাবো।
সাবিন কিছুই বলেনা। ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে বাম হাতের তালু চুলকায়। কি বলবে সাবিন? বললেও কি কণা আদৌ শুনবে? মোটেই না। কণা বলে যায়…,
– আফটার অল হাজবেন্ড বলে কথা।
বলা দরকার বললাম। বুয়াকে সব বলে যাবো।
হনহন করে বেরিয়ে যায় কণা। ঘরের চার দেয়াল আর মাথার উপরে ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানে দাপাদাপি করতে থাকে কথাগুলো। হাজবেন্ড! তাইতো!
আলমিরার বুক ড্রয়ারে সযতনে থাকা কাগজটাতে লেখা আছে, পনেরো লক্ষ এক টাকা দেনমোহরে নিকাহনামা। সাবিনের হাসি পায়, একটুকরো কাগজে আটকে আছে তারা। বাইরে সমাজ আর সম্পর্কের দেয়াল।
এ কটা দিন সাবিনের বেশ ভালোই কেটেছে বলা যায়। বন্ধুদের নিয়ে টাংগুয়ার হাওড় বেড়িয়ে এসেছে। হোটেলে থেকেছে। নগরীর এক অভিজাত হোটেলের রুপটপে বসে সীসা ফুঁকেছে। বলা যায় জীবনটাকে নতুন ভাবে নতুন ছকে বেঁধে ফেলেছে।
সেও এখন অফিস শেষে বেশ রাত করে বাসায় ফেরে। জামা জুতো না খুলেই সোফায় ঘুমিয়ে যেতে পারে। নতুন নতুন শরীরের গন্ধে বিভোর হয়। হাত উজাড় করে বেতনের টাকা উড়াতে পারে। কোন পিছুটান নেই। কারো জন্যে মনের ভেতর কেমন করে উঠা নেই। অফিসে তার সেক্রেটারী প্রিয়া রায় কে যখন তখন ডাকতে পারে। দেদারসে সিগারেট ফুঁকতে পারে। পান করতে পারে।
কটা দিন পরেই কণা ফিরেছে। কটা দিন মানে পাক্কা পনেরো দিন পর। দুই লাগেজ ভরে কাপড় নিয়ে এসেছে। কাপড় কিনতে পনেরো দিন লাগে কিনা! কিংবা সহযাত্রী বা সহযাত্রীনি কে ছিল? কিছুই জানতে চায়নি সাবিন।
কণা এসেই আগেরমতো ব্যাস্ত হয়ে যায়। রাত করে বাসায় ফেরে। তবে একটা ব্যাপার সে লক্ষ্য করেছে। আগে সাবিন তাকে দরোজা খুলে দিত। এখন তাকেই খুলতে হয়। সাবিন বেশ রাতে বাসায় ফেরে। মাতাল ও থাকে কখনো কখনো। কণা এ সবে কিছুই বলেনা। চুপচাপ দরোজা খুলে দিয়ে নিজের রুমে এসে সিটকিনি দিয়ে দেয়।
জীবন বহতা নদীর মতো। থেমে থাকে না। প্রবাহমান।
একটা ছাদ। একটাই রান্নার চুলা। দুটো রুম। দুজন মানুষ। দুটো বিছানা। অথচ একটাই আক্ষেপ। শিকল ভাঙ্গতে না পারার আক্ষেপ। একদিকে কণার সর্ব শ্রদ্ধেয় প্রফেসর বাবা, অন্যদিকে সাবিনের মাওলানা বাবা। জীবন মুচকি হাসে বেলকনির ফাঁকে কিংবা রুপটপ পানশালায়।
কণার সাজসজ্জাতে বেশ পরিবর্তন এসেছে আজকাল। পাতলা শিপন শাড়ি আঁটসাঁট করে পড়ে। নাভীমূল দেখা যায়। পারফিউমের সুগন্ধিতে আশপাশ ভরে যায়। কণাকে নিয়ে সাবিনের অফিসেও বেশ আলাপ চারিতা হয়। ইদানীং সাবিনের বস আমজাদ সাহেব ও রসিয়ে কথা বলেন।
– বুঝলেন সাবিন সাহেব! আপনি একজন রিয়েল
লাইফ পার্টনার পেয়েছেন। স্মার্ট।
ভাবীকে যেভাবে ফ্রীডম দিয়েছেন!
রিয়েলি অসাম। গতরাতে ক্লাবে ভাবীকে দেখলাম।
সাবিন কিছুই বলেনা। মুচকি হেসে পরিস্থিতি সামলে নেয়। ভেতরে ভেতরে বেশ ঘেন্না লাগে কণাকে।
বস্ চলে গেলে প্রিয়া কে ডেকে নেয় সাবিন। প্রিয়া ও সুযোগ পেয়ে সাবিনের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
– ডাইনিটাকে ছেড়ে দাও। চলো আমরা বিয়ে করি।
আজকাল একাউন্টস অফিসার হানিফ সাহেবের সাথে সাবিনের বেশ ভালোরকমের সখ্য গড়ে উঠেছে। অফিস শেষে দুজন একসাথে রুপটপে যায়। পান করে। ডিসকোতে নাচে।
বলা যায় হানিফ সাহেবই সাবিনকে নতুন জগতের সন্ধান দিয়েছে। তারা যে তারকা হোটেলে যায়, বেশ সিকিউরড।
রুমে যারা আসে তাদেরও গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়।
সাবিন আর হানিফ সাহেব প্রায়ই আলাদা রুমে সময় কাটিয়ে আসে। ফ্লোর ম্যানেজারই সব ব্যবস্থা করে রাখে। খবর দেয়। সাবিনের কাছে এ এক অন্যজগত।
শুক্রবারে সাবিনের অফিস থাকেনা। সে বাসায় থাকে। কণা ও আজ বেরোয় নি। ঘরদোর গোছগাছ, বারান্দার টবে পানি দেয়া, হালিমাকে দিয়ে সপ্তাহের রান্নাটা করিয়ে ফ্রীজে মজুদ করিয়ে রাখা, এসব করে কণা।
খাটে হেলান দিয়ে বই পড়তে পড়তে আড়চোখে দেখে সাবিন।
কি অদ্ভুত! কণা, একাধারে অভিমানি, স্বাধীনচেতা, ডেমকেয়ার, আবার সমানতালে সংসারি।
আচ্ছা! সত্যিই কি কণার মনের কোণের কোথাও সাবিন অবশিষ্ট নেই? নেইতো।
যেটুকু আছে সেটা বোধকরি দায়িত্ববোধ। খাবার তৈরী করা। সাজিয়ে রাখা। সবই ঠিক আছে। শুধু মাঝখান দিয়ে ভালোবাসাটা নেই। ভালোবাসা কর্পূরের মতো হাওয়া হয়ে উবে গেছে।
কলিংবেলের আওয়াজে সাবিন হতচকিয়ে উঠে। হালিমা দরোজা খুলে দিলে প্রফেসর সাহেব ঘরে ঢুকেন।
কণা দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। চিৎকার করে ডাকে,
– সাবিন! দেখে যাও বাবা এসেছেন।
সাবিন! সাবিন! অদ্ভুত মায়াময় ডাক। এ ডাক কতদিন শুনেনি সাবিন!
উঁকি দিয়ে দেখে। কি আশ্চর্য! কণা তাকে ডাকছে। ইশারা দিয়ে। সাবিন বুঝতে পারেনা কি করবে। কিংবা এ মুহূর্তে তার কি করা উচিত?
সাবিন মন্ত্রমুগ্ধের মত ডাকের পিছু নেয়। সালাম করে।
প্রফেসর সাহেব সাবিন আর কণার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।
– সুখী হও…। এভাবেই থেকো সারাজীবন।
সাবিন আড়চোখে কণার দিকে তাকায়। কণা ফেলে আসা দিনের ভুলে যাওয়া হাসি হাসে। সাবিনের ভালোই লাগে। লৌকিকতা। ফরমালিটিস।অভিনয়!
জীবন আসলেই রঙ্গশালা। যে যত রঙ্গ জানে, নিখুঁত অভিনয় জানে, সে তত এগিয়ে যাবে। সাবিন অভিনয় জানে কম। কণা তেমনটি নয়। মূহুর্তে বদলাতে পারে।
খাবার টেবিলে কণা তার বাবার পাতে মাছের টুকরো তুলে দেয়। সাবিনের প্লেটেও। প্রফেসর সাহেব কণার মায়ের গল্প করেন। তিনি যে স্বামীপ্রাণ বিদূষী মহিলা ছিলেন, সে কথা বলেন। কণা ও যে তার মায়ের গুনটি পেয়েছে সেটি বলতে ভুলেন না।
সাবিন কিছুই বলেনা। শুধু মাথা নাড়ায়। কণা আরেক টুকরো মাংস তুলে দেয় সাবিনের পাতে। সাবিন জানে, এতে প্রেম নেই। আছে লৌকিকতা। সৌজন্যতা।
প্রফেসর সাহেব বিদায় নেন বিকেল নাগাদ। এরপর তারা দুজন যে যার রুমে চলে যায়। আগেরমতো।
সাংসারিক দু চারটে প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া তাদের মধ্যে তেমন কোন বাক্য বিনিময় হয়না। হালিমা থাকলে বেশিরভাগ প্রয়োজন তার মাধ্যমেই সারা হয়। এভাবেই এগুতে থাকে যাপিত জীবন।
বাইরে গেছে কণা। যাবার আগে মুখে কিছু বলেনি। ডাইনিং টেবিলের উপর সযতনে থাকা বাহারী জগটার নিচে একটুকরো কাগজ রেখে গেছে।
– মনটা বিষিয়ে উঠছে। চেঞ্জ দরকার।
বাইরে গেলাম। দুদিন পর ফিরবো।
সাবিন কাগজটা দেখেছে। গোটা গোটা হাতের লেখা। ঠিক এই ভাবেই কণা তাকে চিঠি লিখতো। চিরকুটে।
টেক্সট কিংবা মেসেজ নয়। যত্ন করে হাতে লেখা। কাট কাট লেখা।
– আসবা? না ঝাঁপ দিবো?
পাগলী মেয়েটার চিরকুট পেয়ে ক্লাসের মাঝপথে দৌড়ে চলে আসতো সাবিন। এসে দেখতো, লাইব্রেরীর সিঁড়িতে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। সেই কণা আজ আর নেই। নিজেও বোধহয় সেই সাবিনটি নেই। আহারে জীবন! যেখানে যেমন।
অফিস শেষে সাবিন আজ বাসায় ফেরেনি। হোটেলে রুপটপের প্রিয় কর্ণারে বসে আছে । পাশের সুইমিংপুলে ভাসছে বিদেশিনী। সাঁঝের বেলায় আলো আঁধারির খেলা। পুলে চুমো খায় কপোত কপোতি। সাবিন গেলাসে বরফের টুকরো ছেড়ে দেয়। তার উপরে প্রিয় জল। গলা ভেজায়। মাথাটা হাল্কা লাগে। মনে হয় পনেরো তলার উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে সে। মেঘের ভেতরে দুহাত মেলে দিয়ে ভাসছে। মেঘের ওপারে কি সুখ আছে?
ম্যানেজার এসে দাঁড়ায় সন্তর্পণে। কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে। সাবিন উঠে দাঁড়ায়। রুম রেডি।
রুমে গিয়ে কমপক্ষে আধঘন্টার শাওয়ার নিবে সে।
আজ রাতটা সে ঘরহীন অন্য ঘরে অন্যভাবে কাটাতে চায়। পরিপাটি রুমে সাবিনের অভ্যস্ততা আছে। হোটেলের মতো না হলেও কাছাকাছি ধাঁচের গোছানো থাকে তার বাসার রুম।
অনেকক্ষণ সময় নিয়ে সাবিন শাওয়ার নেয়। রুম সার্ভিস কল করে রাতের খাবারও সেরে নেয়। এবার তার অপেক্ষার পালা। রাত এগারোটা বাজতে তখনো মিনিট কুড়ি বাকি।
বারান্দায় এসে দাঁড়ালে সমুদ্র দেখা যায়। দূরে সারি সারি নোঙ্গর করা লাইটারেজ জাহাজ। রাতের কালোয় জাহাজের লম্বালম্বি সারিগুলোকে একত্রে একটি জাহাজ বলে মনে হয়। শিরশিরে অনুভূতি জাগানিয়া রাতের হাওয়া এসে লাগে সাবিনের গায়ে। শিহরণ জাগে।
সাবিনের অপেক্ষা নতুন শিহরণের। এই চেনা শহরে চেনা রাত্তিরে এক অচেনা অনুভূতির অপেক্ষায় সাবিন দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকায়।
ঠিক এগারোটায় কলিংবেল বেজে ওঠে। সাবিনের রুমে নরোম আলো। আলো আঁধারির খেলা। দরোজা খুলে দিতেই আপাদমস্তক বোরকায় ঢাকা মেয়েটি ঢুকে পড়ে। সম্ভবত কেউ একজন তাকে রুম অবধি পৌঁছে দিয়ে গেছে। সাবিন বিছানায় গিয়ে বসে। মেয়েটি বোরকা খুলে সোফায় গিয়ে বসে। সাবিন টিউব লাইট অন করতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠে…
– কণা তুমি!