মৃত্যু আজিকে হইলো অমর

মহুয়া ভট্টাচার্য | শুক্রবার , ২৪ ডিসেম্বর, ২০২১ at ১০:২২ পূর্বাহ্ণ

অদম্য সাহসী হার না মানা এক নারীর গল্প বেগম মুশতারী শফী প্রিয় খালাম্মা মহাপ্রকৃতির সাথে লীন হয়ে গেলেন। কিন্তু মৃত্যুতেই সব গল্পের পরিসমাপ্তি হয় না, কোনো মানুষ সমস্ত জীবন ও কর্মে অমরত্বের ছাপ রেখে যান, প্রেরণার আলোকদ্বীপ জ্বালিয়ে যান অহর্নিশ। বেগম মুশতারী শফী তেমনিই একটি নাম।
খালাম্মার সাথে খুব কাছে থেকে একটি বছর কাজ করার সুযোগ হয়েছিলো আমার। যে বছর তিনি অনন্যা ম্যাগাজিন সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হলেন, তার মাত্র কিছুকাল আগেই তিনি হারিয়েছেন তাঁর জ্যেষ্ঠ্য সন্তান এবং এক পুত্রবধূকে। মাস কয়েকের ব্যবধানে এমন শোক নিয়ে যখন মূহ্যমান, তখনই আমি সুযোগ পেয়েছিলাম খালাম্মার একটি আত্মজীবনী লেখার কাজে সহকারী হিসেবে।
আহা কি যে আনন্দের সময় ছিলো তা আমার জন্য তা কেবল আমিই জানতাম। আমার কাজের সময় নির্ধারিত ছিলো বিকেল থেকে দু’ঘণ্টা। তাও প্রতিদিন নয়। সপ্তাহে তিনদিন। খালাম্মা বলবেন, আমি লিখবো। কিন্তু প্রথম দিন থেকেই সেই কাজের সময় বেড়ে হলো তিনঘণ্টা, সাড়ে তিনঘণ্টা, চার ঘন্টা! খালাম্মার মুখে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা, ৭২ পরবর্তীতে সাতটি সন্তান নিয়ে তাঁর জীবন যুদ্ধের কথা শুনতে শুনতে আমি ভুলে যেতাম বর্তমানকে। যেন আমি সেই সময়ের উপকরণ হয়ে উঠতাম তখন। একটা মিষ্টি সুবাস, মা মা গন্ধ খালাম্মার চারপাশে ঘিরে থাকতো। সেই জ্বলজ্বলে নক্ষত্রটি বিদায় নিলেন!
মাত্র তিন মাস বয়সে তাঁর জন্মদাত্রী মা তাকে ছেড়ে গিয়েছিলেন, শৈশব, কৈশোরে বেড়ে ওঠা বড় বোনের কাছে। তাঁর মুখে শুনেছি ৫২’র ভাষা আন্দোলনের মিছিলে যোগ দিতে স্কুলের কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে চলে গিয়েছিলেন জনগ্রোতে, ঘরে ফিরে বোনের বকুনি, শাসন চলেছে তারপর। সেই বিপ্লবের সূতিকাগার নতুন প্রাণ পেয়েছিলেন শহীদ ডা. মো. শফীর সংসারে এসে। সে এক নতুন করে বাঁচা। ডা. মো. শফীর সাথে বেগম মুশতারী শফীর পরিণয় সূত্র গাঁথা হয় বেগম মুশতারীর কৈশোরকালে। ডা. মো. শফী কলকাতার মানুষ হলেও জীবনের নানা চড়াই উতরাই পেরিয়ে তিনি আবাস গড়েন চট্টগ্রামের এনায়েত বাজারস্থ গোয়ালপাড়া এলাকায়। মূলত তিনি দন্ত চিকিৎসক হলেও স্থানীয়দের কাছে তিনি সব রকম রোগেরই পরামর্শদাতা হিসেবে পরিচিতি পান। একজন জনদরদী উদার ও মুক্তমনা অসামপ্রদায়িক চিন্তার মো. শফীর সান্নিধ্যে বেগম মুশতারীর মনের সুপ্ত সাংস্কৃতিক বোধ ও চর্চার আগ্রহ বিকাশ লাভ করতে শুরু করে।
সদ্য বিয়ে করে ঘরে আনা এই কিশোরীটিকে এক তাল কাদামাটির মত করে গড়ে নিতে শুরু করেছিলেন ডা. মো. শফী। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য যেমন সব রকম ব্যবস্থা করলেন, তেমনি সাংস্কৃতিক পরিম-লেও তাকে পরিচিত করানোর সব রকম চেষ্টা শুরু করলেন। ভায়োলিন ও গিটার প্রশিক্ষণ, গান শেখা ইত্যাদি সমস্ত কিছুতেই কিশোর মুশতারী শফীর ছিলো অদম্য আগ্রহ। এরপর ঘর আলো করে আসতে শুরু করে এক একটি সন্তান, তাদের সাথে নিয়েই এগিয়ে গেছেন এই অদম্য মনোবলের কিশোরী। ১৯৬০-এর দশকে তিনি চট্টগ্রামে ‘বান্ধবী সংঘ’ নামে নারীদের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এ সংগঠন থেকে তিনি ‘বান্ধবী’ নামে একটি নিয়মিত পত্রিকা প্রকাশ করেন ও ‘মেয়েদের প্রেস’ নামে একটি ছাপাখানা চালু করেন। তিনি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাথেও যুক্ত ছিলেন। বান্ধবী সংঘই প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাটক মঞ্চায়ন করে চট্টগ্রামে। এবং নাটকের অর্থ দিয়ে সেই সময় বন্যা দুর্গতদের ত্রাণ সাহায্য দেওয়া হয়েছিলো। প্রায় ১০ বছর ধরে তিনি ‘বান্ধবী’ সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বান্ধবীর প্রেস ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি কেবল স্বামী হারাননি, হারিয়েছেন এক যুবক ভাইকেও। তিনি শহীদ জায়া ও শহীদ ভগিনী। ৭২ পরবর্তীতে বেগম মুশতারী শফীর সাতটি সন্তান নিয়ে যে জীবন যুদ্ধ, তা যেকোনো নারীর জন্য একটি বিশাল শিক্ষনীয় ও প্রেরণাদায়ক। তিনি তাঁর ‘স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন’ বইটিতে তাঁর নিজের এবং শরণার্থী শিবিরের থাকাকালীন সময়ের নানা অভিজ্ঞতার কথা অকপটে লিখে গেছেন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগঠক বেগম মুশতারী শফী স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের বেতারের অনুষ্ঠান ঘোষিকা হিসেবে ফের জীবন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সাতটি সন্তান নিয়ে অকল্পনীয় গতিতে এগিয়ে গেছেন। সমকালীন রাজনৈতিক বিরূপতার বিরুদ্ধে লড়াই করেও নিজের মূল্যবোধ ও নৈতিকতাকে বিকিয়ে দেননি কোনো মোহে। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালনটিও সেই সময়কার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মোটেই সহজ কাজ ছিলো না। বেগম মুশতারী শফী এমন এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত ছিলেন, যিনি তাঁর প্রতিবাদ কলমে আবদ্ধ রাখেননি। দেশের সমস্ত সংকট ও বিপ্লবে তিনি রাজপথে নেমে প্রতিবাদ মুখর হয়েছিলেন। তিনি তাঁর আদর্শের স্ফুলিঙ্গ এদেশের মানুষের মধ্যে বিশেষত নারীদের অন্তরে জাগ্রত করে রেখেছিলেন যা কখনো নিভে যাওয়ার নয়।
মহাপ্রস্থানের দিনে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করি আমাদের এই উজ্জ্বল আলোকবর্তিকাকে, তাঁর স্মৃতি ও আদর্শ চির জাগরুক থাকুক আমাদের অন্তরে।
লেখক : গল্পকার, কবি

পূর্ববর্তী নিবন্ধতুমি
পরবর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা