দিন বদল হবে কীনা জানি না তবে মাশা আমিনীর হত্যার প্রতিবাদী বিক্ষোভ এবং আন্দোলনে স্বৈরাচারী সরকারের ভিত যে নড়বড়ে করে দিতে পেরেছে ইরানী নারীরা, সেটা অস্বীকার করার জো নেই। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিতে দীর্ঘদিনের কট্টর ইসলামী শাসনের বেড়াজালে আটকে আছে নারীর মানবাধিকার। গত ১৬ সেপ্টেম্বর কুর্দি তরুণী মাশা আমিনীকে যথাযথ নিয়ম না মেনে হিজাব পরার অভিযোগে অথবা দুই একটা চুল দেখা যাওয়ার অপরাধে গ্রেফতার করা হয় এবং পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় নির্যাতনের কারণে তার মৃত্যু হয়। ধর্মের ধ্বজাধারী তথাকথিত ন্যায় ও সত্যবাদী সরকারি প্রেসনোট বলছে , মাশা আমিনী নাকি মারা গেছে তার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তাদের নির্যাতনের জন্য নয়। আমরাও এরকম প্রেসনোটে অভ্যস্ত। একজন ২২ বছরের তরতাজা তরুণীর হৃদযন্ত্র হঠাৎ করে বন্ধ হওয়ার কারণ একেবারে স্পষ্ট ইরানীদের কাছে তো বটেই এবং পুরো বিশ্ববাসীর কাছেও পরিষ্কার। মাশা আমিনীর হত্যাকাণ্ড শাসক শ্রেণির প্রতি নারীদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, হতাশা ও ক্ষোভ উসকে দিয়েছে নিঃসন্দেহে। এটা আসলে তাদের দীর্ঘ দিনের বঞ্চনার প্রতিবাদ। ধর্মের নামে দুঃশাসনের বেড়াজাল থেকে বের হয়ে আসার আন্দোলন। আগের সব আন্দোলন পুরুষেরা করেছে, এবারের ঘটনা আলাদা। নারীরা শুরু করেছে পুরুষ তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। পুলিশ যখন নারীদের হিজাব পরতে বাধ্য করছে তখন পুরুষ এসে তাদের সাথে লড়াই করছে। এই বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রযন্ত্র ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে এই আন্দোলনে পুরুষের অংশগ্রহণ এই আন্দোলনের গতিপথ নির্ধারিত হয়েছে। আরও কিছু ইসলামী প্রজাতন্ত্র রাষ্ট্রের মতো এই দেশেও নারীর অধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত। এখানে আদালতে দু’জন নারীর সাক্ষ্যকে একজন পুরুষের ধরা হয়। শিক্ষা, চাকরি সব ক্ষেত্রে নারীর সুযোগকে সীমিত করে রাখা হয়েছে। যদি কোনো নারী স্বামীর অনুমতি ছাড়া তার নিজের মা-বাবার সাথেও দেখা করে তাহলে স্বামী তার বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নিতে পারে। নেট ঘেঁটে ইরানি এক মধ্যবয়সী নারীর সাক্ষাৎকার দেখছিলাম যিনি এক বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি সাধারণ একজন মানুষ। শুধু পরিবারকে নিরাপদ ও সুখী রাখতে চাই। কিন্তু সরকার তা অসম্ভব করে তুলেছে। তারা সবকিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে। অর্থনীতি, আমদানি-রপ্তানি, সংস্কৃতি সব শেষ করে দিচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম পছন্দমতো পোশাক পরতে চায়, মুক্তভাবে বাঁচতে চায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করতে চায়। মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ, ইন্টারনেট সেবা বন্ধ, শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রায় ও পুলিশের নিষ্ঠুরতা চলছে। তারা নির্বিচারে হত্যা করছে। সরকার নিয়ন্ত্রিত সব প্রচার মাধ্যম। তারা সত্যটা প্রচার করছে না। প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি। মানুষ তথ্যের স্বাধীনতা চায়। তাদের নিজেদের ভাগ্য বেছে নিতে চায়। ‘ধর্ম রক্ষার দায়, সমাজ রক্ষার দায়, পরিবার রক্ষার দায় সব নারীর উপর চাপিয়ে যে মধ্যযুগীয় শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে তা ভাঙার জন্য সববয়সী নারীপুরুষ নির্বিশেষে ঘর থেকে বের হয়ে এসেছে। পুলিশি অভিযানে নিহতদের মধ্যে তরুণ প্রবীণ নারী পুরুষও রয়েছে। তারা নারী নিষ্পেষণের সমস্ত ব্যবস্থা চালু রেখে, ঘরের দরজা বন্ধ করে বেহেশতের দরজা উম্মুক্ত রাখতে চায়। নারীর পৃথিবীটা দোজখ বানিয়ে তাদের বেহেশত নিশ্চিত করতে চায়। ১৯৭৯ সাল থেকে ইরানের শাসকেরা নিয়ম করেছে নারীদের ঘরের বাইরে অবশ্যই নির্ধারিত নিয়মে হিজাব পরতে হবে। চুল দেখা যেতে পারবে না। বিষয়টি দণ্ডবিধির অনুচ্ছেদ হিসেবে যুক্ত হয়। ১৯৮৩ সাল থেকে এই নিয়ম লঙ্ঘনের তিন ধরনের শাস্তি যুক্ত করা হয়। দুই মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা পাঁচ লক্ষ রিয়াল জরিমানা অথবা ৭৪টি বেত্রাঘাত! এই আইন বাস্তবায়ন করার জন্য ‘গশতে এরশাদ’ নামক বিশেষ বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছে। এদের কাজ হচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্রের ঠিক করা পোশাক নারী ঠিকমতো পরেছে কিনা তা পরখ করে দেখা। সবকিছু রেখে নারীর শরীরই লক্ষ্যবস্তু! মৃত্যুভয়, গ্রেফতার, নির্যাতন সবকিছুই উপেক্ষা করে নারীরা বের হয়ে এসেছে, পোড়াচ্ছে হিজাব, চুল কেটে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। তেহরানসহ প্রত্যেক প্রদেশে ছড়িয়ে পড়েছে বিক্ষোভ। এই ক্ষোভের সাথে যুক্ত হয়েছে কয়েক দশকের দমন, পীড়ন ও দুর্নীতি এবং দেশটির ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি। এই আন্দোলনের পথ ধরে ইরানের নারীমুক্তি ও গণতন্ত্র আসুক। সুশাসন আসুক।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে বেশ কিছুদিন ধরে আমাদের দেশে নারী-পোশাক নিয়ে বিভিন্নরকম বিতর্ক দেখা যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রকে দেখা গেল প্লেকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানাতে। মেয়েদের পোশাকে নাকি তাদের সিডিউস করা হচ্ছে। এটা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। বিচারক সাহেব মেয়েদের সতর্কবার্তা দিয়েছেন। কিন্তু মহামান্য বিচারকের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখে বলছি, এসব ছেলেদের যদি একটু বলা যেতো, তোমরা তোমাদের সীমা লঙ্ঘন করো না, তোমাদের দৃষ্টিকে সংযত করো, তোমাদের মন মনন ও মগজকে নিয়ন্ত্রণ করো, নারীকে সম্মান দিতে শিখো। তাহলে নারী হিসেবে শান্তি পেতাম। কয়েকদিন আগে সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে নারীরা দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনে। দেশের মানুষ ও সরকার তাদেরকে রাজসিক সম্মান জানায়। সাথে সাথে শুরু হয়ে গেলো প্রতিক্রিয়া। তাদের হাঁটু দেখা যায়, তাদের বুক দেখা যায়! যারা খেলা না দেখে অন্যকিছু দেখার মানসিকতা লালন করে এটা তাদের সমস্যা। যারা নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে তারাই দেশকে পিছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। নারী-পুরুষের যৌথ প্রচেষ্টায় দেশ এগিয়ে যায়। নারীকে মানুষ ভাবতে পারার যোগ্যতা অর্জন করাটাই এখন জরুরি।