মৃত্যুঞ্জয়

শিপন চৌধূরী | বুধবার , ৯ ডিসেম্বর, ২০২০ at ১০:১৩ পূর্বাহ্ণ

মহল্লার সবাই তার নামটি দিয়েছিল মৃত্যুঞ্জয়। জন্মের একটু পরেই, পড়েছিল সে ময়লার ভাগাড়ে। কুকুরের মুখের খাদ্য হতে হতে বেঁচে ফিরেছিল সে। এ নামই তো তার হয়। মহল্লার যে পাগলী বুড়িটা, দুটি সন্তান যার ভেসে গেল গত বানে। কুড়িয়ে খেয়ে হোটেলের বাসি যত, ঘরে ফিরছিল একাকী আনমনে দেখল একটু দূরে এক শ্বাপদের দল মিলে কী যেন একটা ঘিরিয়া ফেলেছে প্রায়। কান পেতে শোনে একটু এগিয়ে গেলে এরি মাঝে এক মানব শিশুর ক্রন্দন শোনা যায়। হাতের লাঠিটি মুঠি করে ধরি শ্বাপদের দিকে হেঁকে। কী যেন মোহে ছুটে গেল বুড়ি জীবনটা বাজি রেখে। শিশুটিকে পেয়ে বুড়ি হলো তৃতীয় বারের মত মা। নতুন করে বুনল আবার স্বপ্ন বাসনা কত। নিজে না খেয়ে তুলে দিত সব মৃত্যুঞ্জয়ের মুখে। আপন মা-ও এমন করেনা বলত সবাই দেখে।
ভিক্ষাও করে এখন বুড়ি যা কখনও করেনি আগে শিশুর কাপড়ে, ওষুধে, দুধে অনেকটা টাকা লাগে। এভাবেই সুখ-দুঃখ মিলিয়ে যাচ্ছিল দিন চলে। পাড়ার ছেলেরা খেপাত তাকে ‘বুড়ির ছেলে’বলে। পরীক্ষাতে যেবার প্রথম হলো নন্দলালকে ফেলে। নন্দের বাবা বলেছিল, ‘এত মার্কস তুই কী করে পেলি জারজ বেজন্মা ছেলে’ -কান্না জড়িয়ে গলাটা ফুলিয়ে বুড়িমার কাছে গিয়ে বললো, তুমি তো আমার মা কিন্তু বাবাটি আমার কে? বুড়িমা তারে চুমু খেয়ে বলে, বোকা ছেলে মোর ওরে।জন্ম দিলেই মা বাপ হয় – কে বলে একথা তোরে?
জন্ম দিতে তেমন কিছুই লাগেনা, লাগিয়ে দিলেই হয়। মা বাপ হতে যোগ্যতা লাগে অতটা সহজ নয়। এমন কথাতো মৃত্যুঞ্জয় কারো কাছে শোনেনি- চারদিকে যে তবে এত বাপ মা-তাদের যোগ্যতা আসলে কি! তবে যে ছোট্ট এদেশে এত জনসংখ্যা, কেন এ বিস্ফোরণ? কেন সবাই শুধু জন্মই দেয় কুকুর ছানার মতন। থাকগে সেসব কথা। মুখ যিনি দিয়েছেন, এ নাকি তার একারই মাথাব্যথা। এমন করেই চলছিল তাদের মা-ছেলে, মা-ছেলে খেলা। বুঝতে পারেনি বুড়ি আর ছেলে গড়িয়েছে কত বেলা। একদিন ভোরে গলির মুখে থামিয়ে নতুন গাড়ি। নেমে এল এক রূপসী মহিলা পরনে সুতির শাড়ী। পাড়ার মেয়েরা কানাকানি করে,’কত অপরূপা ইনি! ‘যুবক চুনিলাল চোখ টিপে বল,আমি তো এটাকে চিনি।
চন্দ্রমুখী নামটি যে তার, সবাই মিস ছদ্ম নামেই ডাকে। শহরের সবচে দামী বেশ্যালয়ে সে যে এখন খাকে। ভিন পাড়ার এক যুবকের সাথে ফষ্টিনষ্টি করে বাপের অমতে পালিয়েছিল প্রেমিকের হাত ধরে। বুড়ির বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মৃত্যুঞ্জয়কে দেখে বললো ছন্দা, ধনরে আমার, আয় এ শূন্য বুকে। জন্ম দিয়েই ফেলে গেছিলাম, উপায় ছিল না আর। কত যুগ পরে দেখলাম তোরে, ফুরাল অপেক্ষার। সে দিন ছিলাম রিক্ত শূন্য, আজ আমার সবই আছে চল আমার সাথে, কিনে দেব সুখ, যত বায়না আমার কাছে’কাপড় গুচিয়ে মৃত্যুঞ্জয়, বইগুলো নিয়ে হাতে প্রবীণা বুড়িরে ছেড়ে চলল নতুন মায়ের সাথে। চুপচাপ চেয়ে ছিল বুড়িমা, বললো না কোন কথা। বাঁচার সে সুখ পারেনি তো দিতে, এবার ঘুচবে ব্যথা। যাবার কালে, মাথায় হাতটা বুলিয়ে বললো একটু থামি। যাচ্ছিস যা, শুধু সুখে থাক বাপ, এইটুকু চাই আমি। ছেড়ে দিল গাড়ি, উড়িয়ে ধুলি, মিলালো দিগন্ত সীমারেখায়। সেই থেকে বুড়ি হারাল নিজেকে নিস্তব্ধতায়। কদিন যেতে না যেতে সেই ভাগাড়েই মরেছিল বুড়ি কাক ডাকা এক ভোরে। দেহের মাংসগুলো শ্বাপদে খেয়েছে, শুধু কঙ্কাল ছিল পড়ে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনীরব ঘাতক স্মার্টফোন !
পরবর্তী নিবন্ধসুন্দর কর্মের মাঝে বেঁচে থাকা