অর্থনীতিতে ব্যাপক আলোচিত শব্দটি মুদ্রাস্ফীতি। অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় যে, নির্দিষ্ট সময়ে একটি অর্থনীতিতে দামস্তর যখন ক্রমাগত বাড়তে থাকে তখন তাকে উক্ত অর্থনীতির মুদ্রাস্ফীতি বলে। যেহেতু দামস্তর বৃদ্ধি পেলে তাকে মুদ্রাস্ফীতি বলা হয় সেহেতু কোনো কোনো সময় তাকে মূল্যস্ফীতিও বলা হয়। মূল্যস্ফীতি কেন হয়? এর একটি সহজ উদাহরণ দেয়া যায়। মনে করি বাংলাদেশে যে পরিমাণ পণ্য সেবা রয়েছে তা হচ্ছে ১০০০ একক। উক্ত ১০০০ একক এর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রা (টাকা) ছাপিয়েছে ২০০০ টাকা। সেক্ষেত্রে প্রতি একক পণ্য সেবার দাম হবে ২ টাকা। মনে করি পণ্য ও সেবার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়নি। সরকার তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজ প্রয়োজনে আরো এক হাজার টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছেড়েছে বা অর্থের জোগান বৃদ্ধি করেছে। তাহলে একক প্রতি পণ্য ও সেবার দাম হবে ৩ টাকা। অর্থাৎ পূর্বের তুলনায় পণ্য ও সেবার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এটিই মূল্যস্ফীতি।
কিন্তু সরকার তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে পরিমাণ টাকা বা মুদ্রা বাজারে ছাড়ে সেই পরিমাণ টাকা বাজারে স্থির থাকে না, টাকার প্রচলন গতি রয়েছে। অর্থনীতির ভাষায় বলা হয়, ‘একটি টাকা একদিনে যতজনের হাত বদলায় (দ্রব্য ও সেবা ক্রয়ের ক্ষেত্রে) ঠিক তত টাকার কাজ করে। তাকে অর্থের প্রচলন গতি বলে। অর্থের প্রচলন গতির কারণেও অর্থের জোগান বৃদ্ধি পায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি একদিন সকালে আপনার পকেটে ১০০টি টাকা থাকে তবে সকালে আপনি যদি ১০০ টাকার নোটটি দিয়ে টিফিন করেন তাহলে আপনার ১০০ টাকা নোটটি চা-এর দোকানের মালিকের কাছে চলে গেল। আপনি মহাসুখে ১০০ টাকা টিফিন করে নিলেন। একটু পরে দোকান মালিক ঐ ১০০ টাকার নোটটি দিয়ে চিনি ক্রয় করে বাসায় পাঠিয়ে দিল। নোটটি এখন মুদির দোকানের মালিকের কাছে। মুদি দোকানের মালিক ঐ ১০০ টাকার নোটটি দিয়ে চিংড়ীমাছ কিনে রান্না করার জন্য ঘরে পাঠিয়ে দিল। নোটটি এখন চিংড়ী বিক্রেতার কাছে। চিংড়ী বিক্রেতা উক্ত ১০০ টাকার নোটটি দিয়ে দুই কেজি চাউল কিনে বাড়ি চলে গেল। নোটটি এখন চাউল বিক্রেতার কাছে। সকাল থেকে মাত্র ১২ টার মধ্যে অর্থাৎ চার ঘন্টার মধ্যে আপনার পকেটের ১০০ টাকার নোটটি দিয়ে আপনি টিফিন করলেন, চা দোকানের মালিক ১০০ টাকার চিনি কিনে নিল, মুদি দোকানের মালিক উক্ত ১০০ টাকার নোটটি দিয়ে চিংড়ীমাছ কিনে নিল, চিংড়ী বিক্রেতা ঐ ১০০ টাকার নোটটি দিয়ে দুই কেজি চাউল ক্রয় করে নিল। মাত্র চার ঘন্টার মধ্যে ১০০ টাকার নোটটি চারজনের হাত বদল করেছে এবং ৪০০ টাকার কাজ করেছে। দিনের অবশিষ্ট সময় আরো হাত বদল হতে পারে। সুতরাং এই নোটটি আরো টাকার কাজ করবে। ইহাকে অর্থের প্রচলন গতি বলে। কাজেই অর্থের প্রচলন গতির ওপর নির্ভর করে মোট অর্থের জোগানের পরিমাণ। আর অর্থের জোগান যতই বৃদ্ধি পাবে ততই পণ্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি ঘটবে।
বাংলাদেশে ২০২০ সাল থেকে নিত্যপণ্যের মূল্য অন্যান্য বছরের তুলনায় বাড়তে শুরু করছে। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৯.৫২%, যা ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর জরিপ বলেছে, ৬৮% মানুষ খাবার কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। ২০২০ সালের জানুয়ারী মাসকে যদি আমরা ভিত্তি বছর হিসেবে ধরে নিই তবে ১ জানুয়ারী ২০২০ সালের তুলনায় ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টিসিবি সূত্রে দেখা যায়, বাংলাদেশে মোট চাউলের মূল্যবৃদ্ধির হার হচ্ছে ৫৩%, সরু চাউলের মূল্যবৃদ্ধির হার হচ্ছে ৪৪%। খোলা আটার দাম বেড়েছে ৯৬% আর খোলা ময়দার দাম বেড়েছে ৫৮%। সয়াবিন, মসুর ডাল, চিনি, ডিম, ব্রয়লার মুরগি ইত্যাদি পণ্যেরও দাম বেড়েছে সমান গতিতে। যেখানে ২০২০ সালের জানুয়ারীতে খোলা সয়াবিনের লিটার প্রতি দাম ছিল ৮৬ টাকা সেখানে ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে এ পণ্যের লিটার প্রতি দাম দাঁড়ায় ১৬২ টাকা। মসুর ডালের কেজি ছিল ৫৫ টাকা। আর ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে মসুর ডালের কেজি প্রতি দাম হয় ৯৫ টাকা, মূল্যবৃদ্ধির হার হয় ৭৩ শতাংশ। একইভাবে চিনি ও ডিমের দাম ২০২০ সালের জানুয়ারী মাসে ছিল প্রতি কেজি ৬২ টাকা ও প্রতি হালি ডিম ৩২ টাকা। আর ২০২২ সালের অক্টোবরে তা হয় ৯০ টাকা ও ৪৫ টাকা। মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ৪৫ শতাংশ ও ৪১ শতাংশ। ব্রয়লার মুরগির দাম ২০২০ সালের জানুয়ারীতে ছিল কেজি প্রতি ১১০ টাকা। আর ২০২২ সালের অক্টোবরে তা হয় ১৮০ টাকা। মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ৬৪ শতাংশ। হঠাৎ করে দুই বৎসরের ব্যবধানে পণ্যের মূল্য এত বৃদ্ধি পেল কেন? ২০২২ সালের প্রথমদিকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে। একসময়ে টঝঝজ বলে কথিত বিশাল দেশটি ভেঙ্গে যায়। ফলে অন্যান্য আরো দেশের ন্যায় জন্ম নেয় ইউক্রেন নামক একটি দেশ। এ দেশটি ভাষা, সংস্কৃতি অনেকাংশে রাশিয়ার ন্যায়। কিন্তু বিপদ বাঁধে ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেয়া নিয়ে। ইউক্রেন চায়, ইউরোপের দেশসমূহের সংগঠন ন্যাটোতে যোগ দিতে। আর রাশিয়া চায় ইউক্রেন যোগ না দিক। মূলত এখান থেকে যুদ্ধ শুরু।
অতিসম্প্রতি বিশ্বব্যাংক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বিশ্বব্যাংক মনে করে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে জ্বালানি পণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হতে শুরু করে। এর ফলে বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। ২০২২ সালে জ্বালানি পণ্যের দাম বেড়েছে ৬০ শতাংশ। অবশ্য আগামী বছরে দাম কিছুটা কমার পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। কিন্তু বর্তমান সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় উন্নয়নশীল দেশগুলো বিপাকে পড়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের উদাহরণ টেনে বলা হয়েছে যে, ইউরোপের বাজারে এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ সমস্যায় পড়েছে। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এজন্য ব্যাপক লোডশেডিং করতে হচ্ছে, কারণ এলএনজির মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ স্পষ্ট মার্কেট থেকে এ জ্বালানি কিনতে পারছে না।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে যে, প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার কারণে নানা ধরণের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বিশ্বজুড়ে। সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ায় জ্বালানি পণ্যের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এতে আগামী শীতে ইউরোপে সংকট প্রকট হতে পারে। জ্বালানী পণ্যের দাম প্রত্যাশার চেয়ে বেশি বেড়ে গেলে তা খাদ্যপণ্যের নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে। জ্বালানী তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, যা খাদ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এ দেশের জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য সংস্থান এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। যদিও বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ তবুও প্রাকৃতিক কারণে উৎপাদন কম হলে খাদ্য আমদানি করতে হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্য ভান্ডার ক্রমাগত ছোট হয়ে আসছে। অতএব বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকট অবশ্যম্ভাবী। আর এরূপ খাদ্যসংকট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এ দেশের প্রত্যেক নাগরিককে খাদ্য অপচয় বন্ধ করতে হবে এবং উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর জোর দিতে হবে।
লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভারসিটি।