সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে স্বাধীন বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি তার লক্ষ্য এবং চেতনা থেকে আজ আমরা যোজন যোজন দূরে চলে এসেছি। সামাজিক অবক্ষয় আমাদের গ্রাস করেছে সর্বক্ষেত্রে। মূল্যবোধের সংকট আজ সর্বগ্রাসী। এটি বায়ান্ন বছর পরে এসে হয়নি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই পরাজিত শক্তি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। তারা পাকিস্তানি ভাবধারায় এই দেশকে পরিচালিত করার নীলনকশা নিয়ে দেশে– বিদেশে তৎপর ছিল এবং এখনও তারা থেমে নেই। তারই ধারাবাহিকতায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশকে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রতিক্রিয়াশীল ধারাটি প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে তৎপর ছিল। তাদের দোসররা খোলস পাল্টে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির মিছিলে ঢুকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী কাজে লিপ্ত হয়ে তাদের মিশন বাস্তবায়নের কাজ করে গেছে। এখনও তারা সমানে সক্রিয়। মূল্যবোধের সর্বগ্রাসী সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে দেশকে একটি নীতি–নৈতিকতাহীন দেশে পরিণত করাই তাদের অভিষ্ট লক্ষ। এতে কে আসল আর কে বর্ণচোরা তার বাচবিচারের ক্ষমতা আমজনতা হারাতে বসেছে। মূল্যবোধের সংকট আজ এতই তীব্র আকার ধারণ করেছে ন্যায়–অন্যায় বোধটুকুই লোপ পেতে বসেছে লোভের অনলে। মহান একুশে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যে মূল্যবোধ আমাদের গঠিত হওয়ার কথা তা চাপা পড়ে গেছে লোভ–লালসার কাছে। যে যেভাবে পারে বিপুল অর্থ–বিত্তের মালিক হতে চায়। কখনো নদ– নদী দখল করে, কখনো জনবসতিকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে নির্বিচারে বালু উত্তোলন করে বা নগর–বন্দরের রাস্তা–ফুটপাত দখল করে এরা বড়লোক হতে চায় এবং হয়। তারপর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সরকারি জমি দখল, ভুয়া দলিল বন্ধক রেখে ব্যাংকের টাকা লুটে মনযোগী হয় এবং সফলও হয়। বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তা তাদের অনুপ্রেরণা যোগায়।
আমরা দেখি, এখানে বিসমিল্লাহ্ নাম দিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়। নামে– বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা বিদেশে পাচার করার সংবাদ এখন নিত্যকার বিষয়। খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ঠেলে দিতে অসাধু ব্যবসায়ীর বিবেকে একটুও বাঁধে না। ডিম–মুরগী–পেঁয়াজ সবকিছুর দাম নিয়ন্ত্রণ করে সিন্ডিকেট শত শত কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে। ইটের গুঁড়া, ধানের চিটা মিহি করে পাউডার বানিয়ে তার সাথে কিছু চিটামরিচের গুঁড়া এবং লাল রং মিশিয়ে মরিচ হিসেবে বিক্রি করার সরজমিন অনুসন্ধানী রিপোর্ট করতে গিয়ে দেখেছি যারা এসব করে তারা এই কাজকে শুধুমাত্র লাভের ব্যবসা হিসেবে দেখেন। নীতি– নৈতিকতার প্রশ্ন তাদের কাছে গৌণ। চিকিৎসকের কাছে গেলে একগাদা প্যাথলজিক্যাল টেস্ট করার জন্য পাঠিয়ে দিয়ে কমিশন প্রাপ্তির ফাঁদ যারা বসান তারাও দেখেন না রোগীর অর্থনৈতিক সামর্থ্য। ভেজাল ওষুধ উৎপাদন, বিপণন এবং তা প্রেসক্রাইব করে রোগীকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেন যারা তাদের কাছে মানবিকতা বা মূল্যবোধের কি–ইবা দাম আছে। ইয়াবা, ফেনসিডিল, আইসসহ নিত্যনতুন ক্ষতিকর মাদকের ব্যবসা করে রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাচ্ছেন সমাজের একটি অংশ। দেশের যুবসমাজকে ধ্বংসের দ্ধারপ্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে বলে তাদের এতটুকু অনুশোচনা নেই। বরং সমাজে এদের কেউ কেউ দানবীর– সমাজহিতৈষী হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছেন। অনেকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে কালো অধ্যায়কে আড়াল করে সমাজে এলিট শ্রেণি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছেন।
নীতি– নৈতিকতার শিক্ষা আমরা পাই পরিবার, সমাজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যের বিরুদ্ধে যখন আমরা একগাদা দুর্নীতি– অনিয়মের অভিযোগ শুনি, মেয়াদ শেষে রাতের আঁধারে যখন কোনো উপাচার্যকে ক্যাম্পাস ত্যাগ করার খবর পড়ি বা উপাচার্য হয়েই নিজ পুত্র–কন্যা, শালা–শালী, ভাগ্নে–ভাতিজা এবং লতাপাতার সব আত্মীয়স্বজনকে নিয়মবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিতে দেখি তখন এটাতো জোর গলায় বলতে ইচ্ছে করে সমাজে সর্বত্র লেগেছে পচন। রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ মালবাহী ভ্যান–রিকশা বা ট্রাক থামিয়ে দশ–বিশ টাকা নেওয়ার ছবি পত্রিকায় ছাপিয়ে আমরা বাহবা নিই। কিন্তু খাতায়–কলমে জাল–জালিয়াতি করে লক্ষ–কোটি টাকা মেরে দেন যারা তাদের আমরা মাথায় তুলে নাচি। পেশাজীবী সংগঠনে এসব দুর্নীতিবাজদেরই নেতৃত্বের আসনে বসাই। মানবিক মানুষ হওয়ার যে শিক্ষা ও গুণাবলি অর্জন করা দরকার সেই শিক্ষা কোথায়, কার কাছে পাবে আগামী প্রজন্ম। সবাই এখন যে কোনো পন্থায় বড়লোক হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। হোক তিনি ব্যবসায়ী, আমলা, সাংবাদিক, শিক্ষক, চিকিৎসক। এই প্রতিযোগিতায় যারা আছেন তারা এগিয়ে যাচ্ছেন। সকল পেশায় সৎ ও ভাল মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি হলেও দূষিত এই সমাজে তারা অবহেলিত–অপাঙক্তেয়। অসৎ এবং নীতিভ্রষ্টদের দাপটে তারা অসহায়। নীতি– নৈতিকতা ও মূল্যবোধ আজ কেবল বুলিতে পরিণত হয়েছে। পরিবার–সমাজ ও রাষ্ট্রে আদর্শের চর্চা নেই। ধর্মীয় আদর্শের নামে চলছে বিকৃত চর্চা। তরুণদের একটি অংশ বিপদগামী হয়ে ঝুঁকছে উগ্র জঙ্গীবাদের দিকে। সুস্থধারার বিনোদন, সাংস্কৃতিচর্চা এবং খেলাধূলার সুযোগ সীমিত। তরুণ– প্রবীণ সবাই আসক্ত ফেসবুক, ইন্টারনেটে। বই, পত্র–পত্রিকা পাঠে আগ্রহীর সংখ্যা কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। নানান অসঙ্গতি, বৈষম্য ও সুশাসনের অভাব সমাজকে অবক্ষয়ের দিকেই ধাবিত করছে। আগামী প্রজন্মের কাছে আমরা কী দিয়ে যাচ্ছি? মানবিক মূল্যবোধে দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে তাদের গড়ে তোলার জন্য দরকার সঠিক দিকনির্দেশনা। কে দেবে এই নির্দেশনা? সর্বগ্রাসী এই সংকট থেকে উত্তরণে চাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার কঠিন লড়াই।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক।