মুহাম্মদ মুজিবুর রহমানের ‘দেখা থেকে লেখা’ ও ‘সময় সংলাপ’

আবু মুসা চৌধুরী | বৃহস্পতিবার , ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:২৫ পূর্বাহ্ণ

এক বহুমাত্রিক বিচিত্রগামী ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান। লেখালেখি, সমাজকর্ম, বাণিজ্য – ইত্যাকার বিপরীতমুখি মন ও মানস এর সমন্বয় যদিও দুরূহ, তবুও ইতিহাস শাস্ত্রের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী এই কৃতীজনের রচিত গ্রন্থ দু’টো সময়ের সত্যসন্ধ ভাষ্য।
এ বছরের একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত মুহাম্মদ মুজিবুর রহমানের ‘সময় সংলাপ’ ও ‘দেখা থেকে লেখা’ বই দু’টো বলা যায় রচয়িতার জীবন ও যাপনের আদ্যোপান্ত সারাৎসার। লেখকের জবানি : “সহজ সরল ভাষায় নিজের দেখা বিষয় ও অনুভূতিগুলো বর্ণনা করার চেষ্টা করেছি। আমার লেখার বিষয়সমূহ চলার পথের অভিজ্ঞতা থেকে সংগৃহীত। … সজ্ঞানে পাঠকবৃন্দের কাছে আমি আমার দেখা ও উপলব্ধিতে আসা বিষয়গুলো লেখার মাধ্যমে তুলে ধরে এর নৈতিক মানদণ্ডের রূপ খোঁজার চেষ্টা করেছি …।”
এতদ্‌ বিক্রিয়ায় গ্রন্থিত রচনাসমূহে ব্যক্তিসত্তা প্রকটিত হলেও, লেখকের সাধু ঝরঝরে শৈলী বা গদ্যের কারণে তা মনোগ্রাহী ও উত্তীর্ণ। এ ছাড়া পরিবেশনায় লেখক অকপট ও আন্তরিক। তাঁর পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধির পরিধিও সুক্ষ্ম, সচেতন ও মর্মভেদী।
যদিও রিপোর্টাজধর্মী লেখা, তবুও আত্মজীবনী, স্মৃতিচারণ, দিনলিপি – এতোসব বিবিধ আঙ্গিকের মিশেলে মুজিবুর রহমানের লেখা বস্তুত সাহিত্য গুণসম্পন্ন।
‘দেখা থেকে লেখা’ ও ‘সময় সংলাপ’ গ্রন্থ দু’টোর বিষয়ের পরিধি গ্রাম নগর কিংবা পাশ্চাত্য অবধি বিস্তীর্ণ। মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান ভ্রামণিক মুগ্ধতায় গ্রাম পর্যবেক্ষণ করেননি। তাঁর গ্রাম ভাবনা আত্ম-সংলগ্ন ও নিবিড়। গ্রামীণ স্কুল শিক্ষকের সন্তান যদিও নাগরিক শিক্ষা ও কৌলিণ্যে আকীর্ণ, তবুও তাঁর গ্রামচর্চা সম্পুর্ণ অকৃত্রিম। কেননা তিনি নিজে একজন শিক্ষা সংগঠক – গ্রামে স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং আপাদমস্তক গ্রামহিতৈষী; তাই তাঁর গ্রামবীক্ষণ নিঃসন্দেহে গ্রাম নীরিক্ষা বা ক্ষেত্র জরিপের সম পর্যায়ভুক্ত। আর তা ইতিহাসের মৌলিক উপাদানও বটে।
মুহাম্মদ মুজিবুর রহমানের উপলব্ধি কেবল ব্যক্তিক নয়, তা পারিবারিক গণ্ডি স্পর্শ করে। সামাজিক চৌহদ্দি, পারিবারিক ইতিবৃত্তও রচিত হয় তাঁর ভাবনা বৃত্তে।
তাঁর রচনায় রয়েছে হাস্যরস, সামাজিক অসঙ্গতি, শ্রেণি চারিত্র্য/শ্রেণি বিন্যাস/শ্রেণি বিভাজন, কুসংস্কার ইত্যাদি অনুষঙ্গ সমুহ। সর্বোপরি বলা যায় গ্রামীণ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় জারিত মুজিবুর রহমানের উপলব্ধি ও পর্যবেক্ষণ।
অজস্র চরিত্র এসে ভর করেছে এই গ্রন্থ দু’টিতে। লেখকের আন্তরিক বয়ানে তা উৎকর্ষ অর্জন করে। মুজিবুর রহমান অত্যন্ত অনুভূতিপ্রবণ। তাঁর পিতাকে নিয়ে রচিত লেখাটি পাঠকের মর্মমূল স্পর্শ করে। আর্দ্র করে।
অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ, ড. আবদুল করিম, ড. আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন, ড. জামাল নজরুল ইসলাম প্রমুখ কীর্তিমানের সান্নিধ্যধন্য মুহাম্মদ মুজিবুর রহমানের এই গ্রন্থ দু’টি কেবল দেশের চৌহদ্দিতে আবদ্ধ নয়। ব্যবসায়িক কারণে তিনি পরিভ্রমন বরেছেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, পর্তুগাল, হল্যাণ্ড, বেলজিয়াম, কানাডা, লুঙ্মেবার্গ, সৌদি আরব ও সিঙ্গাপুর। এ কারণে তাঁর মন ও মননে বহুস্তর-উদার-আধুনিক বিশ্ববীক্ষা পুঞ্জিভূত হয়েছে।
মুহাম্মদ মুজিবুর রহমানের নীরিক্ষণ একরৈখিক (ঋষধঃ) সাধামাটা নয়। জীবনের গভীর গভীরতর উপলব্ধি ও সত্যও তিনি প্রকাশ করেন। যেমন – ‘আমার বাবার মৃত্যু এবং কিছু কথা’ রচনায় তাঁর প্রতীতি : “আমার বাবার মৃত্যু সংবাদে যেমন জীবনের গভীরতম বেদনার শেষে আমি আক্রান্ত তেমনি বোধের বিচেনায় দায়িত্ব সম্পাদনের সুযোগ প্রাপ্তির স্বস্তি আমার মধ্যে উঁকি দিচ্ছে।” জীবনের এই রূঢ় বাস্তবতার অভিরেখ একজন নির্মোহ দার্শনিকের দৃষ্টিভঙ্গিজাত। এ এক দুর্লভ ক্ষমতা। এমন দৃষ্টান্ত মুহাম্মদ মুজিবুর রহমানের রচনার পরতে পরতে ইতি উতি ছড়িয়ে আছে প্রচুর।
মুহাম্মদ মুজিবুর রহমানের গদ্যশৈলীও সহজ-সরল-স্বতঃস্ফূর্ত এবং প্রাণবন্ত। তাঁর রচনায় কোন আড়ম্বর নেই বাহুল্য নেই। অজস্র চরিত্র, ঘটনার ঘনঘটায় লেখক-পাঠকের প্রাণ-সংযোগ সৃষ্টি হয় অনায়াসেই।
তাঁর অনেক রচনা মোটিভেশনাল। এক ধরনের নৈয়ায়িক শুদ্ধাচারসুলভ এবং তা অস্বাভাবিকও নয়। কেননা তিনি এবজন সাত্ত্বিক শুদ্ধচারী ব্যক্তিত্ব।
তো, সবকিছু মিলিয়ে সুলেখক মুহাম্মদ মুজিবুর রহমানের গ্রন্থদ্বয়ের মূল বৈশিষ্ট্য প্রসাদগুণ – যা সর্বতোভাবে পাঠকমন জয় করতে বরাবরই সহায়ক। গন্থদ্বয়ের বহুল প্রচার কাম্য।
দেখা থেকে লেখা – মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান। প্রচ্ছদ: দীপক দত্ত, প্রকাশক: জামাল উদ্দিন, বলাকা প্রকাশন। মূল্য: ৩৫০ টাকা
সময় সংলাপ – মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান। প্রচ্ছদ: দীপক দত্ত, প্রকাশক: জামাল উদ্দিন, বলাকা প্রকাশন। মূল্য: ২৫০ টাকা
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিনোদনের নামে ‘বিজাতীয় সংস্কৃতি চর্চা পরিহার করি
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজ কাল