মুসলিম বিয়ে ও নারীর দেনমোহর

নারীর জন্য আইন

| শনিবার , ৪ মার্চ, ২০২৩ at ৯:২২ পূর্বাহ্ণ

দেনমোহর হল কিছু টাকা বা কোনো সম্পত্তি যা বিবাহ চুক্তির একটা শর্ত হিসাবে স্বামীর নিকট থেকে স্ত্রী পাওয়ার অধিকারী হয়। দেনমোহর স্বামীর জন্য ঋণ বিশেষ। অনেকেই ভুলবশত ভেবে থাকেন তালাক দিতে গেলেই কেবল দেনমোহর দিতে হয়। তাই বিয়ের সময় সামর্থ্যের বাইরে গিয়েও দেনমোহর ধার্য্য করা হয়ে থাকে, যাতে দেনমোহর পরিশোধের চাপে পড়ে বিবাহবিচ্ছেদ না হয়। আদতে এটি একটি ভুল ধারণা। দেনমোহর তালাকের সাথে সম্পর্কিত নয়। দেনমোহরের সম্পর্ক মূলত বিয়ের সাথে।

ইসলাম ধর্মে বিবাহ একটি দেওয়ানী চুক্তি, যার উদ্দেশ্য হল বৈধভাবে দুজন প্রাপ্তবয়ষ্ক নরনারীর দাম্পত্য জীবনযাপন। ইসলামে বিয়ে কোন সংস্কার বা ধর্মানুষ্ঠান নয়। এটি শুধুই একটি দেওয়ানী চুক্তি। অন্যসব চুক্তির মতো বিয়েও মূলত একটি চুক্তিগত ক্রিয়াকর্ম। বিয়ে যেহেতু একটি চুক্তি তাই এক্ষেত্রেও দুটো পক্ষ থাকে। পক্ষ দুটো হচ্ছে ছেলে ও মেয়ে।

বিয়ের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে, প্রাপ্তবয়স্ক দু’জন ছেলে ও মেয়ের মধ্যে স্বেচ্ছা সম্মতিতে বিয়ে অনুষ্ঠিত হবে। সুতরাং বিয়ের ক্ষেত্রে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে ও একজন প্রাপ্তবয়স্কা মেয়েই মূল ফ্যাক্টর।

মুসলিম বিয়ের পাঁচটি শর্ত। ১. বয়স: ছেলে ও মেয়ের বয়স যথাক্রমে কমপক্ষে ২১ ও ১৮ বছর হতে হবে।

.সম্মতি: উক্ত বিয়েতে ছেলে ও মেয়ে উভয়েরই সম্মতি থাকতে হবে।

. দেনমোহর: বিয়েতে উভয়ের আলোচনা ও সর্বসম্মতিক্রমে দেনমোহর ধার্য করতে হবে।

.সাক্ষী: বিয়েতে দুপক্ষেরই দুজন করে মোট চারজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে চুক্তি সম্পাদন করতে হবে।

. বিয়ে যেহেতু চুক্তি তাই এটির রেজিস্ট্রেশন/কাবিননামা সম্পন্ন করতে হবে।

সুতরাং বিয়ের শর্ত অনুযায়ী দেনমোহরও একটি শর্ত। দেনমোহর বিয়ের সময় দিতে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে আইন আমাদের দেশের দেনমোহরকে দ’ুভাগে ভাগ করেছে। একভাগ তাৎক্ষণিক দেনমোহর, যেটি স্ত্রী চাইবামাত্র দিতে হবে। এটি না পাওয়া পর্যন্ত স্ত্রী সংসারে যেতে অস্বীকার করতে পারে। অন্যটি বিলম্বিত, যেটি তালাক হয়ে গেলে বা স্বামী মারা গেলে স্বামীর সম্পত্তি থেকে স্ত্রী পাবে। স্বামী তার স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধ না করে মারা গেলে তা পরিশোধের দায়িত্ব ওয়ারিশগণের ওপর বর্তায়।

দেনমোহরের জন্য কোনো সর্বোচ্চ পরিমাণ নির্ধারিত নেই। স্বামীর সামর্থ্যের বাইরেও তা নির্ধারিত হতে পারে। তবে উভয়পক্ষকে বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। দেনমোহর একবার নির্ধারিত হয়ে গেলে তা স্ত্রীর কাছে স্বামীর ঋণ বিশেষ। তাই অর্থনৈতিক সামর্থ্য বিবেচনায় তা নির্ধারিত হওয়া উচিত।

স্ত্রীকে তালাক দিলে দেনমোহর দিতেই হবে। তালাক যদি উভয়ের সম্মতিতে হয়, বা একপক্ষের ইচ্ছেতে হয় কিংবা কারণে হয় বা কারণ ছাড়াও হয় তাতেও দেনমোহর দিতে হবে। বিয়ে প্রাপ্তবয়সে হোক বা অপ্রাপ্ত বয়সে হোক সব মুসলিম বিয়েতে অবশ্যই দেনমোহর দিতে হবে। কারণ বিয়ের পাঁচটি আবশ্যকীয় শর্তের মধ্যে দেনমোহর একটি শর্ত। অনেকে ভাবতে পারে, মেয়েরা তালাক দিলে দেনমোহর দাবি করতে পারে কি না! হ্যাঁ, স্ত্রী নিজে থেকে তালাক দিলেও সে দেনমোহর দাবি করতে পারে। কারণ এটা স্ত্রীর কাছে স্বামীর ঋণ। ঋণ শোধ করতে ব্যক্তি বাধ্য।

স্ত্রীর চরিত্রহীনতা, পরকীয়া কিংবা অন্যান্য অপরাধ উত্থাপন করে অনেকে দেনমোহর থেকে মুক্তি পেতে চায়। সেক্ষেত্রে তালাক দিতে বাধা না থাকলেও আইন ও ধর্মমতে ঋণ পরিশোধ করা যেমন নৈতিক দায়িত্ব ঠিক তেমনভাবে স্ত্রীর দেনমোহর ঋণ হিসেবে পরিশোধযোগ্য। দেনমোহর তালাকের সাথে সম্পর্কিত নয় বিধায় স্ত্রী স্বামীকে তালাক দিলেও দেনমোহর পাবে, তালাক না দিলেও দেনমোহর পাবে।

একটি মেয়েকে দেনমোহর আদায়ের ক্ষেত্রে আইন তাকে সহায়তা করে। স্বামী স্বইচ্ছায় দেনমোহর প্রদান না করলে স্ত্রী আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে।

১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের ধারা ১০এ মোহরানা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, বিবাহের কাবিননামায় কি ধরনের দেনমোহর স্ত্রীর পাওনা হবে, তা নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা না থাকলে দেনমোহরের পুরো অর্থ স্ত্রী চাওয়ামাত্রই পরিশোধযোগ্য। সালিশী পরিষদের আদেশ বলে এটি কার্যকর হলে স্ত্রীর তা পাওনা হয়ে যায়। পরিশোধ না করলে ১ মাস কারাদণ্ড বা ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

১৯৮৫ সনের পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশের মাধ্যমে পারিবারিক আদালতে দেনমোহর/মোহরানার জন্য মামলা নিষ্পত্তির নিরঙ্কুশ এখতিয়ার প্রদান করা হয়েছে। তাই ঋণ পরিশোধের সাধারণ নীতিমালা ও মোহরানা আদায়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। অন্যান্য ঋণের মতো ঋণদাতা যেখানে অর্থাৎ স্ত্রী যে এলাকায় বসবাস করেন সে এলাকার পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করলেই আদালত দেনমোহরের টাকা আদায় করে দেবে।

রিমঝিম আহমেদ

শিশু সুরক্ষা সমাজকর্মী

প্রবেশন কার্যালয়, সমাজসেবা অধিদফতর

চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাখমুত ঘিরে ফেলেছে রাশিয়ার ভাড়াটে সেনারা
পরবর্তী নিবন্ধবসন্তবিলাপ