বসন্তবিলাপ

সালমা বিনতে শফিক | শনিবার , ৪ মার্চ, ২০২৩ at ৯:২৩ পূর্বাহ্ণ

মাঘের শেষ রাতের আগের রাত্রিতে কুষ্টিয়ার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের গণরুমে এক নবাগত ছাত্রীকে টানা সাড়ে চার ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। তাকে চড় খাপ্পড় লাথি থেকে শুরু করে অকথ্যভাষায় গালাগাল করা হয়, এবং এক পর্যায়ে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করে তা

 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। আর এই ঘটনা প্রকাশ করলে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়। স্বভাবতই মনে হতে পারে মেয়েটি হয়তো কোন পুরুষ সহপাঠী দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে, ঠিক যেমন করে আবরার ফাহাদ নির্যাতিত ও নিহত হয়েছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের

ছাত্রাবাসে। কিন্তু না, তা নয়। আমাদের মেয়েরা যে পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বোধ করি তার প্রমাণ দিতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীনিবাসে সহপাঠীকে আটকে রেখে নির্যাতন করে ওরা দেখিয়ে দিল।

ঘটনা বা অঘটন যাই বলিনা কেন, সমাজে তা ‘ভাইরাল’ হয়নি, কারণ আক্রান্ত মেয়েটি মরে যায়নি। আর তাই আমাদের মনে কোন দাগই কাটেনি জাতীয় পত্রিকার প্রথম পাতায় স্থান পাওয়া এই সংবাদ। কারণ আরও আছে; আমরা যে মেতে আছি বসন্ত বরণের উৎসবে। সমাজ ভেসে যাক, ভেস্তে যাক, ডুবে যাক,

কি রসাতলে যাক, উৎসবে আমাদের ছেঁদ পড়েনা, বরং দিনে দিনে তার মাত্রা ও কলেরব বৃদ্ধি পায়। কুষ্টিয়ার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের ছাত্রীরা ছত্রিশ ঘণ্টা আগের সেই অপ্রীতিকর ঘটনার কথা ভুলে গিয়ে বাসন্তী সাজে শরীর ও মন রাঙিয়ে মেতেছিল উৎসবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

দু’একজন অবশ্য সংবাদকর্মীদের জানিয়েছেএমন ঘটনা এখানে প্রায়ই হয়। নেতৃস্থানীয় কিছু মেয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকে হলের সবকিছু। ভুক্তভোগী যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে, তারা যথারীতি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং এসব কুচক্রীদের ষড়যন্ত্র বলে উড়িয়ে দিয়েছে। তবে তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে যে

ছাত্রীনিবাসের মেয়েদের ভালমন্দের দেখভালের দায়িত্ব ‘তাঁরা নিষ্ঠার সাথে পালন করে থাকেন’ এবং হলের প্রাধ্যক্ষের দেওয়া দায়িত্বও তাঁরা পালন করেন।

সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া এসব গল্পকাহিনী শুনে অবাক হওয়ার ধাপ আমরা অনেক আগেই পেরিয়ে এসেছি; এ আর এমন কী ! এমনইতো হওয়ার কথা ছিল। এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। খোদ রাজধানীর বুকেও ঘটেছে। আর প্রতিনিয়তই ঘটে চলেছে। নেত্রীর কোনরকম অসম্মান হলে সাধারণ

ছাত্রীদের রক্ষা থাকে না। হেন বিষয় নেই যা নিয়ে কলহ মারামারিতে মেতে ওঠে না আমাদের শিক্ষিত (!) মেয়েরা। ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে এবারও শাড়ি বিতরণ নিয়ে মারামারি করেছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের ছাত্রীরা। ‘ছাত্রীনিবাসের মেয়েদের ভালমন্দের দেখভালের দায়িত্ব পালনকারী’ এসব মহান (!)

নেত্রীরা একদিন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা কিংবা আইন প্রণেতার আসনে বসে পড়লেও আমাদের অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তখন আমরাই ওদের নামে জয়োধ্বনি দেব আর নারীর ক্ষমতায়নের নামে আস্ফালন করে যাব।

বাংলাদেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় কেবল নয়, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এমন দু’ চার জন কিংবা ততোধিক নেতা নেত্রী আছেন যারা সকলের দেখভাল করেন, সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁদের বিরুদ্ধে আঙুল তোলার সাধ্য কারও নেই। আইন, বিচার, প্রশাসন তাঁদের হাতের মুঠোয়। আমাদের বাংলাদেশে নিতান্ত সাধারণ

পরিবারের মেয়েরাই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে প্রবেশের আগে একেকজনকে কঠিন অগ্নি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। লেখাপড়া নিয়ে সংগ্রাম ছাড়াও আর্থসামাজিক নানা প্রতিকূলতার পাহাড় ডিঙিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতায় নাম লেখায় একেকটি মেয়ে। তাদের অশিক্ষিত বা

অল্পশিক্ষিত বাবা মায়ের রক্ত জল করা অর্থে বড় হওয়া এই মেয়েদের নিয়ে স্বপ্নের শেষ নেই পাড়া গাঁয়ের, দেশ ও সমাজের। প্রকৃতির কোলে মাটির মমতায় বেড়ে ওঠা মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিয়ে নিজেদের শক্তি, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার স্বাক্ষর রাখবে, দেশগাঁ আর পরিবারের স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যাবেএমনটাই

প্রত্যাশা। সব প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে মেয়েদের বড় একটা অংশ (একই সঙ্গে ছেলেদের বড় একটা অংশও) তলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের পথে। আমরা দেখেও দেখছি না। যারা পারছে পাততাড়ি গুটিয়ে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। যাদের পালাবার পথ নেই, তারা ভাবলেশহীন দিন পার করে দিচ্ছে। স্বার্থান্বেষী মহল এই সুযোগে

আমাদের ছেলেমেয়েদের মধ্য থেকে সমস্ত মানবীয় গুণাবলী কেড়ে নিয়ে সহিংসতা ও উন্মত্ততার বীজ বপন করে চলেছে। এর শেষ কোথায় ? আগামী দিনের কর্ণধারদের খাদের কিনারায় রেখে আর কত আমরা মেতে থাকব উৎসবের উন্মাদনায়?

পরিসংখ্যান বলে, উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় আমার দেশে শিক্ষার হার বেশী। এ তবে কেমন শিক্ষা! বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাসে শিক্ষার্থীদের আচরণে শিক্ষার লেশমাত্র দেখা যায়না। শিক্ষার সঙ্গে মানবিকতা ও সহনশীলতার সংযোগ না ঘটলে সেই শিক্ষা বড় অর্থহীন হয়ে পড়ে। তারই প্রমাণ আমরা প্রত্যক্ষ

করছি সমাজের সর্বত্র। দ্রুতগতিতে বাড়ছে শিক্ষার হার, কিন্তু শিক্ষার সৌন্দর্য হারিয়ে যেতে বসেছে। শিক্ষার আসল শক্তি কি, আর শিক্ষার দর্শনই বা কিএসবে আমাদের জনমনে আগ্রহ নেই বললেই চলে। আমরা উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে চলেছি অজানার পথে। পালা করে উৎসব পার্বণ পালন করা ছাড়া সৃষ্টিশীল কোন কাজেই আমাদের পাওয়া যায় না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুসলিম বিয়ে ও নারীর দেনমোহর
পরবর্তী নিবন্ধলামায় ধর্ষণ মামলার আসামি গ্রেপ্তার