মুক্ত হোক ডিসি হিল

রোকসানা বন্যা | সোমবার , ২৬ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৮:১৭ পূর্বাহ্ণ

ডিসি হিল চট্টগ্রাম শহরের নন্দনকানন বৌদ্ধ মন্দির সড়কে অবস্থিত। এটি চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রবিন্দু। এই ডিসি হিলকে ঘিরে এই শহরবাসীর অনেক স্বপ্ন। আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকার জায়গা হলো এই ডিসি হিল। সকাল, বিকেল, সন্ধ্যায় এই পাহাড়ের পাদদেশে মানুষ শ্বাস নিতে যায়। বেঁচে থাকার প্রেরণা পায়। শহরের এই একটি জায়গা যেখানে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে মানুষ। আমার মতো অনেকেই এই জায়গায় খুব স্বাচ্ছন্দ্যে হেঁটে বেড়াতে পারে। আমার খুব প্রিয় এই ডিসি হিল। সারাদিনের ক্লান্তির পর ওখানে গেলেই ভালো লাগে খুব।

ইতিহাস বলে, ইংরেজ শাসনামলের গোড়ার দিকে এখানে চাকমা রাজার বাড়ি ছিলো। পরবর্তীতে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের (ডিসি) বাসভবন স্থাপিত হওয়ায় কালক্রমে এই পাহাড় ডিসি হিলনামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম এখানে অবসর সময় কাটিয়েছেন। জাতীয় কবির এই আগমনকে স্মরণীয় করে রাখতে ১০ এপ্রিল ২০০৫ সালে ডিসি হিলের নতুন নামকরণ করা হয় নজরুল স্কয়ার। ১৯৭০ এর দশকের শেষভাগ থেকেই এখানে পহেলা বৈশাখ, বর্ষবরণ খুব জাঁকজমকের সাথে, উৎসব নিয়ে পালিত হয়ে আসছে। উল্লেখ্য, নগরীর নন্দনকাননে দৃষ্টিনন্দন ডিসি হিলের চূড়ায় চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের সরকারি বাসভবন আছে। আর পাহাড়ের পাদদেশে নজরুল মুক্তমঞ্চে বিভিন্ন সংগঠনের সাংস্কৃতিক আয়োজন করতো, যার অনুমতি নিতে হতো জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে। তবে মুক্তমঞ্চ তৈরির আগে থেকেই বর্ষবরণের আয়োজন হতো ডিসি হিলে।

২০১৭ সালে জেলা প্রশাসন শুধু বাংলা বর্ষবরণ ছাড়া ডিসি হিলে সবধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন বন্ধ ঘোষণা করে। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর প্রতিবাদের মুখেও তৎকালীন জেলা প্রশাসক এই সিদ্ধান্তে অনঢ় থাকেন। এমনকি জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন বিধি নিষেধের কারণে ২০১৮ সালে ৪০ বছর ধরে আয়োজিত বর্ষবরণের অনুষ্ঠানও অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছিল। এইসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে চট্টগ্রামের সর্বস্তরের সংস্কৃতিকর্মীরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছিলেন। শুধু বর্ষবরণ আর দুতিনটে ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়া আর কিছুই এখন হতে পারে না। অথচ এই আমাদের মতন যারা আছেন তারা হাঁটাহাঁটির পাশে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও উপভোগ করতে পারতেন। অথচ এখন এসবের কিছুই করতে পারে না। বরঞ্চ তাঁদের নিরাপত্তার কথা ভেবে যতবারই নতুন ডিসি চট্টগ্রামে আসেন একটা করে বাড়তি গেইট দিয়ে পাহাড়ের হাঁটার জায়গা সংকুচিত করেছেন। অথচ একটা সময়ে এই আমরাই ওপরে যেতে পারতাম। চট্টগ্রামের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারতাম। ব্যায়াম করা যেতো ওই খোলা চত্বরে। আর কত নিরাপত্তা প্রয়োজন একজন ডিসির? সারাক্ষণ পুলিশ নিয়োজিত থাকে, তাতেও তাঁদের পোষায় না। অথচ ঢাকায় তাঁরা কীভাবে থাকেন সেটা একবার ভাবা দরকার।

গত কয়েকদিন আগে হাঁটতে গিয়ে আমার জুতো ছিঁড়ে যাওয়াতে আমি বসার মতো কোনো বেঞ্চ পেলাম না। দুইমাস আগেও বেঞ্চ ছিলো কিছুদূর পর পর। পথচারী যেন একটু জিরিয়ে নিতে পারে। খবর নিয়ে জানলাম ডিসি সাহেব বদলি হওয়ার আগে আগে বেঞ্চগুলো ভেঙে ফেলেছেন। কেন ভেঙেছেন প্রশ্ন করাতে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট একজন জানালেন, ‘স্কুলকলেজের ছেলেমেয়েরা এসে গল্প করে, আপত্তিকর কাজ করে’। আমি ভাবতে পারছি না এই খোলা চত্বরে কতটুকুই বা আপত্তিকর কাজ করতে পারবে? আর নিরাপত্তারক্ষীদের কাজ কী তাহলে? এই সামান্য পাহারাই যদি দিতে না পারেন। তাই বলে বেঞ্চ ভেঙে ফেলবেন ডিসি সাহেব এটা কেমন কথা! এই বেঞ্চ তো ওনার ব্যক্তিগত টাকায় বানানো হয়নি। এই কোন জগতেই যে বাস করছি জানি না। নতুন আইন করে রাত আটটার মধ্যে সবাইকে বের করে দেন গেইটম্যান। মাইক হাতে অনেরা বাইরন চাই। তারপরও ক্ষান্ত নন। নার্সারির সব গেইট নার্সারির মালিকগণ তালা লাগিয়েও শান্তি পান না। ডিসি সাহেবের তালাও ওই তালার ওপর ঝোলানো হয়। একটা গেইটে দুটো করে তালা ঝোলে।

৫ নভেম্বর বিকেলে নগরীর সিআরবি চত্বরে ‘নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রাম’ আয়োজিত সমাবেশে বর্ষীয়ান রাজনীতিক আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসককে ‘ডিসি হিলের’ ওপর থেকে তাদের বাসভবন সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সমাবেশে সাবেক গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘ডিসির এই পাহাড়ের ওপর থাকার কোনো দরকার আছে? কোনো প্রয়োজন নেই। চট্টগ্রামে এসে পাহাড়ের ওপরে বিশাল বাড়িতে থাকে। বদলি হয়ে যখন ঢাকায় যায় যুগ্মসচিব হয়ে, তখন একটা বাসার জন্য আমাদের পেছনে পেছনে ঘোরে’। ‘প্রয়োজন নেই’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এত বড় পাহাড়ের ওপর ডিসির থাকতে হবে কেন? চট্টগ্রামে তো আরও অনেক জায়গা আছে। সেখানে বাংলো বানিয়ে থাকুক। ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনারের জন্য অন্য জায়গায় আবাসনের ব্যবস্থা করা হবে। পাহাড় ছেড়ে দেন। এখনও দাবি তোলার সুযোগ আছে। এই ডিসি হিলকে আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ পার্ক করতে চাই’।

সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ না হওয়ার আশ্বাস যেমন পেয়েছি, ডিসি হিলের আশ্বাসটুকুও যেন কার্যকর হয়। নয়তো এই চট্টগ্রামবাসীর বিনোদনের জায়গাটুকুই আর থাকবে না। কিছুদিন হলো ঢাকার রমনা পার্কে গিয়েছিলাম। এতো সুন্দর, এতো বিশাল। বড় বড় গাছ, খোলা চত্বরে, লেকের ওপর হাঁটার জায়গা। আর কিছুদূর পর পর বসবার বেঞ্চ দেখে সত্যি দুঃখ হলো আমাদের শহরটা এর চেয়েও আরও বেশি সুন্দর হতে পারতো। প্রকৃতিগতভাবেই এই শহর পাহাড়, নদী দ্বারা বেষ্টিত। একটু মনোযোগ আর যত্নের প্রয়োজন শুধু।

প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি করজোরে মিনতি করে। এই শহরের মানুষকে তার পুরাতন ডিসি হিল ফিরিয়ে দেয়া হোক। এতোএতোস্তরের নিরাপত্তার বেষ্টনী যেন দেখতে না হয় আমাদের। নতুন ডিসি সাহেব এসেছেন কিছুদিন হলো। তিনি যেন সাধারণ মানুষকে সাধারণভাবে বাঁচতে দেন। বেঞ্চগুলো ঠিকঠাক করে দেন যেন একজন পথচারীর সুবিধার্থে। ছেলেমেয়েদের গল্প করাভালোবাসা খারাপ কাজ নয়। এরা বন্ধ কোনো রেস্টুরেন্টের চেয়ে এখানে বসে মনের দুচারটা কথা বললে দোষের কিছুই দেখছি না। জয় হোক মানবতার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানকুমারী বসু : কবি ও সমাজ সংস্কারক
পরবর্তী নিবন্ধসঞ্চয়পত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিল নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে