মুক্তির নেশায় মাকে খুন!

সপ্তাহখানেক আগে পরিকল্পনা, ২০ মে রাতে বাস্তবায়ন পালিত মেয়েকে হেফাজতে নিল পুলিশ

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ২৬ মে, ২০২৪ at ৭:২৪ পূর্বাহ্ণ

মা চাইতেন পালিত মেয়েকে আগলে রাখতে। আর মেয়ে ভাবত এ যে পরাধীনতার শৃঙ্খল। মুক্তির নেশায় সে মাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিল পূর্বপরিকল্পিতভাবে, ঝগড়ার ছুতোয়। পরে চোর ঢুকে মাকে খুন করে পালিয়েছেএমন নাটক সাজাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। সব শেষে পুলিশের প্রশ্নের তোপে অকপটে স্বীকার করে, পুরো ঘটনা সে একাই ঘটিয়েছে। এ ঘটনায় নিহতের প্রথম পক্ষের বড় ছেলে আরিফুল হক মাসুম বাদী হয়ে পাহাড়তলী থানায় মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় শুক্রবার সন্ধ্যায় আনোয়ারা বেগমের পালিত মেয়েকে হেফাজতে নেয় পুলিশ। গতকাল শনিবার ওই কিশোরীকে চট্টগ্রাম আদালতে হাজিরের মাধ্যমে সংশোধনাগারে পাঠিয়েছে পাহাড়তলী থানা পুলিশ। সিএমপির উপকমিশনার (পশ্চিম) নিহাদ আদনান তাইয়ান আজাদীকে বলেন, মেয়েটি যোগব্যায়াম, নাচ, মার্শাল আর্ট এসব শিখতে চাইত। টিউশনি করে রাতে দেরি করে বাসায় ফিরত। মা আনোয়ারা বেগম এসব পছন্দ করতেন না। এসব বিষয় নিয়ে মায়ের সাথে অনেকদিন ধরে তার মনোমালিন্য চলছিল। এতে মেয়েটির মনে ধারণা জন্মে, মা থাকলে সে তার স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পারবে না। নিজের মতো জীবনযাপন করতে পারবে না। তাই সপ্তাহখানেক আগে মাকে খুনের পরিকল্পনা করে এবং ২০ মে রাতে তা বাস্তবায়ন করে। নিহত আনোয়ারা বেগম (৫৭) নগরীর পাহাড়তলী থানার দক্ষিণ কাট্টলী ছদু চৌধুরী রোডে চৌধুরী আবাসিক এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় পালিত মেয়েকে নিয়ে থাকতেন। তাদের বাড়ি সন্দ্বীপ উপজেলায়। পালিত মেয়ে ১৭ বছর বয়সী কিশোরী স্থানীয় একটি কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী বলে পুলিশ জানিয়েছে।

সিএমপির সহকারী কমিশনার মঈনুর রহমান জানান, আনোয়ারা বেগমের প্রথম সংসারে তিন ছেলে আছে। প্রথম স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সেই সংসারে কোনো সন্তান না হওয়ায় মেয়েটিকে দত্তক নিয়েছিলেন। বছরখানেক আগে দ্বিতীয় স্বামীও মারা যান। দ্বিতীয় স্বামীর বোনের লন্ডন থেকে পাঠানো টাকা এবং আগের সংসারের তিন ছেলের সাহায্য নিয়ে তিনি পালিত মেয়েকে নিয়ে থাকতেন।

তিনি বলেন, মেয়েটি ছিল আনোয়ারা বেগমের অত্যন্ত আদরের। সবসময় তাকে চোখে চোখে রাখতেন। মেয়ে সম্প্রতি ইউটিউবের ভিডিও দেখে বাসায় যোগাসনসহ বিভিন্ন ধরনের যোগব্যায়াম শুরু করে। একইসঙ্গে ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পী মালবিকা সেনের ভিডিও দেখে তার নাচের মুদ্রা অনুশীলন করত। আনোয়ারা বেগম এসব পছন্দ করতেন না। তার মনে আরও সন্দেহ হয়, মেয়ে অমুসলিম কোনো ছেলের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে পড়েছে। এ নিয়ে মামেয়ের মধ্যে মনোমালিন্য বাড়তে থাকে। মেয়ে ভাবে মাকে না সরালে সে এসব কিছুই করতে পারবে না।

পুলিশ জানিয়েছে, আনোয়ারা বেগমকে হত্যা করতে আগেই পরিকল্পনা করে নেয় মেয়েটি। টিউশনি শেষে প্রতিদিন রাত ১১টার দিকে বাসায় ফিরলেও ২০ মে রাত ১০টায় ফেরে। ১০১৫ মিনিট সে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয়। এরপর মায়ের সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে ঘরে থাকা একটি কাঠের টুকরা দিয়ে মাথায় বারবার আঘাত করে। এতে আনোয়ারা বেগম গুরুতর আহত হন। এ সময় তিনি মাটিতে বসে পড়েন। তার মাথা থেকে রক্ত ঝরছিল।

জিজ্ঞাসাবাদে মেয়েটি পুলিশকে আরও জানায়, ওই অবস্থায় আনোয়ারা বেগমকে রেখে সে ১০ মিনিট অপেক্ষা করে। তারপর ঘরের দরজা খোলা রেখে বাইরে গিয়ে কাঠের টুকরাটি ফেলে দেয়। এরপর ওই কিশোরী আশপাশের বাসিন্দাদের জানায়, চোর এসে তার মাকে মাথায় আঘাত করে গুরুতর জখম করে চলে গেছে। ঘরে এসে দরজা খোলা অবস্থায় এবং মাকে আহত অবস্থায় দেখতে পেয়েছে। আনোয়ারা বেগমের ছেলেদেরও ফোনে একই কথা জানায় সে। স্থানীয়দের সহায়তায় গুরুতর আহত আনোয়ারা বেগমকে শুরুতে পাহাড়তলী থানার ফইল্যাতলী বাজার এলাকার তাইসেফ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা আনোয়ারাকে আইসিইউতে ভর্তির পরামর্শ দেন। চমেক হাসপাতালে আইসিইউ বেড খালি না থাকায় এশিয়ান স্পেশালাইজড অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভর্তি করানো হয়। ২১ মে রাত সাড়ে ১০টায় তিনি মারা যান।

পুলিশ কর্মকর্তা নিহাদ আদনান তাইয়ান বলেন, শুরুতে মেয়েটি আমাদের বলেছিল চোর এসে কাঠের টুকরা দিয়ে আনোয়ারা বেগমকে মাথায় মেরে চলে গেছে। সে ঘরের মধ্যে কাঠের টুকরাটি দেখেছে। পরে যখন আমরা কাঠের টুকরাটি ঘরে খুঁজে পাইনি, তখন সন্দেহের সূত্রপাত হয়। এরপর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করি। মেয়েটির মোবাইল ফোন ঘেঁটে মায়ের প্রতি তার রাগের কিছু সূত্র পাই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ভিডিও দেখে এবং কিছু বইপত্র পড়ে সমাজ ব্যবস্থার প্রতি ওই কিশোরীর এক ধরনের বিরাগ জন্মে বলে ধারণা করছেন তদন্তকারীরা। সন্দেহ হওয়ায় মেয়েটির মানসিক অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, একটি ছেলেকে সে পছন্দ করত। অবশ্য ছেলেটি তেমন কিছু জানত না; অর্থাৎ মেয়েটির এক পক্ষীয় পছন্দ ছিল। ঘটনায় ব্যবহৃত কাঠের টুকরাটি ওই কিশোরীর দেখানো স্থান তাদের রান্নাঘরের পাশে একটি ডোবা থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলাদেশ ব্যাংকের নজর এড়িয়ে কীভাবে অর্থ পাচার হয়, প্রশ্ন দুদকের
পরবর্তী নিবন্ধচালের বস্তায় ধানের জাত ও দাম লেখার নির্দেশনা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি