মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোন কোটা চান না, পরিবার পরিজনের চাকরিও চান না, চান না কোন ভাতাও। শুধু বুক ভরা অভিমান নিয়ে মারা যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা আলী আহমদের স্বীকৃতি চেয়েছেন স্বজনেরা। স্বাধীনতার ৫০বছরের মাথায় এসে একজন কূটনৈতিক যোদ্ধার স্বজনরা প্রধানমন্ত্রীর আকুতি জানিয়েছেন তাঁকে যেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়ার। কোন ধরনের সুযোগ সুবিধা না নিয়েও শুধু স্বীকৃতির জন্য দুয়ারে দুয়ারে ধর্ণা দিচ্ছেন তারা।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পটিয়ার সুচক্রদন্ডি ইউনিয়নের ডেঙ্গাপাগা গ্রামের আলী আহমদ ১৯৭১ সালে সিঙ্গাপুরের পাকিস্তান হাই কমিশনে কর্মরত ছিলেন। ওই সময় ৩৯ বছর বয়সী আলী আহমদ দূতাবাসের সাংকেতিক ভাষা সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের খবর নানা মাধ্যমে জানতে পেরে তিনি ৭১ সালের ৮ নভেম্বর রাতে দূতাবাস ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। স্ত্রী ও দুই শিশু সন্তানকে সাথে করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি সিংগাপুর থেকে দিল্লি চলে যান। সিংগাপুর ত্যাগ করার আগে আলী আহমদ সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে তার পক্ষত্যাগের বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। বিষয়টি চিঠি আকারে তিনি পাকিস্তানের সামরিক জান্তা প্রধান ইয়াহিয়া খান, সিঙ্গাপুরে পাকিস্তান দূতাবাসের প্রধান এম আর ইসলাম এবং চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের কাছেও পাঠান। এই চিঠিতে তিনি ইয়াহিয়াকে পূর্ববাংলার গণহত্যার জন্যে অভিযুক্ত করেন এবং চীনের প্রধানমন্ত্রীকে পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহারের আবেদন জানান। তিনি চীনা দূতাবাসের কাছে এই চিঠি পাঠান। তার পাঠানো চিঠিতে তিনি গণহত্যার প্রতিবাদে তার পদত্যাগের কথাও উল্লেখ করেন। সিঙ্গাপুর থেকে দিল্লি পৌঁছে তিনি বিবিসিকে একটি সাক্ষাতকার দেন, যা প্রচারিত হয়। বিশেষত, ওই সময় পাকিস্তানি দখলদারের দ্বারা অবরুদ্ধ বাংলাদেশের জনগণের জন্যে দেশের পরিস্থিতি জানার অন্যতম সূত্র ছিল ভয়েস অব আমেরিকা ও আকাশবাণীর পাশাপাশি এই ব্রিটিশ বেতার সমপ্রচার মাধ্যম। বিবিসিতে আলী আহমদের সাক্ষাতকারটি মুক্তিকামী আপামর বাঙালিকে দারুণভাবে আলোড়িত ও উদ্বুদ্ধ করে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার আলী আহমদকে কলকাতায় বাংলাদেশ হাই কমিশনে কূটনৈতিক দায়িত্ব প্রদান করে। একজন বাঙালি কূটনীতিক হিসেবে তিনি মুজিবনগর সরকারের যুদ্ধকালীন পররাষ্ট্র নীতি প্রচার ও বাস্তবায়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সাহসী ভূমিকা পালন করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বঙ্গবন্ধুর সরকার তাকে কলকাতার বাংলাদেশ মিশন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত করেন।
আলী আহমদের পারিবারিক সূত্র জানায়, যে বাংলাদেশের জন্য দূতাবাসের চাকুরি ছেড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আলী আহমদ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সেই স্বাধীন বাংলাদেশে ’৭৫ পরবর্তীতে তাকে পদে পদে হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে। গ্লানি আর অভিমান নিয়ে তিনি চাকরি জীবন পূর্ণ না করে ১৯৮৬ সালে স্বেচ্ছায় অবসরে যান এবং অপরিণত বয়সে ১৯৯৮ সালে মারা যান। সিঙ্গাপুরের সংবাদপত্রে আলী আহমেদের পক্ষ ত্যাগের সংবাদ প্রকাশ; ইয়াহিয়া, চৌএনলাই এবং পাকিস্তানি দূতাবাস প্রধানকে লেখা তার প্রতিবাদী চিঠি এবং বাংলাদেশের হয়ে কাজ করার দলিল দিয়েও একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি স্বীকৃতি পাননি। ১৯৮২ সালে ১৬ খণ্ডে প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের ৩য় খণ্ডের ৮৮১ পৃষ্ঠায় আলী আহমেদের পাকিস্তানি পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ষোষণার বিবরণী অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অথচ তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি না পেয়েই মারা গেছেন। আলী আহমদের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী শাহদাৎ নাহার এবং পরিবারের অন্য সদস্যগণ দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন স্বীকৃতির জন্য। তারা বলেছেন, আমাদের কোন কোটার প্রয়োজন নেই। কোন ভাতারও দরকার নেই। কোন সুযোগ সুবিধাও চাইনা। শুধু একটু স্বীকৃতি চান, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি।
আলী আহমদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে প্রবাসী। মেয়ে নাসরিন ফাতেমা গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধের সাহসী সৈনিক ছিলেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়কালে তিনি কূটনৈতিক অঙ্গনে অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর সাহসী ভূমিকা অনেকেরই প্রশংসা কুড়িয়েছিল। কিন্তু স্বাধীন দেশে আমার পিতার স্বীকৃতি জুটেনি। আমরা কোন সুযোগ সুবিধা চাইনা, শুধু বাবা যে একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তিনিও এই দেশের যুদ্ধে সামিল হয়েছিলেন সেই স্বীকৃতিটুকু চাচ্ছি। নাসরিন ফাতেমা প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।