বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারী -পুরুষ নির্বিশেষে সবাই অংশগ্রহণ করেছিল, যে যার মত করে। যুদ্ধে বাংলার নারীদের অবদান ছিল গৌরবদীপ্ত, বীরত্বপূর্ণ। কেউ বন্দুক হাতে, কেউ আশ্রয় দিয়ে, কেউ খাবার সরবরাহ করে, কেউ আহতদের সেবা করে। আবার অনেকে গান গেয়ে, খবর পাঠ করে এবং গোপনে তথ্য সরবরাহ করে মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেরণা দিয়ে পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।
অনেক বীর বাঙালি নারী জীবনের মায়া ত্যাগ করে সম্মুখ বন্দুক হাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে লড়াই করেছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, দুর্বিসহ পথ অতিক্রম করে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। অনেকে চোখের সামনেই তাঁর প্রিয় পুত্র, স্বামী, পিতা, ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করতে দেখে স্বেচ্ছায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের এই অবদান অস্বীকার করা বা ছোট করে দেখার অবকাশ নেই।
পাকিস্তানিদের সাথে বাঙালিদের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল সেই ১৯৪৮ সাল থেকেই। তখন থেকেই বাঙালি নারী-পুরুষ এক হয়ে আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন। বায়ান্নর একুশে ফেব্রয়ারি নারীই প্রথম ১৪৪ ধারা অমান্য করে মিছিল সমাবেশ করেছিলেন। পুলিশের লাঠিচার্জ এবং গুলিতে অনেকেই গুলিতে আহতও হয়েছিলেন সেদিন। এ ঘটনায় গ্রেফতারের সংখ্যাও কম নয়। ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৪ সালে সুফিয়া কামাল, সানজিদা খাতুনসহ আরও অনেক নারী নেত্রী দাঙ্গা বিরোধী কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিলেন। ৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে নারীরা রাজপথে মিছিল মিটিং করে যুদ্ধের প্রতিবাদ করেন। ১৯৬৬ তে ছয় দফা আন্দোলনে ৫০০ নারী সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। ৬৯ এর গণআন্দোলনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন গ্রেফতার করা হয়। তখন সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে কারফিউ চলাকালীন হাজার হাজার নারী শহীদ মিনারে সমাবেশ করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অনেক নারী নির্বাচনী প্রচার থেকে শুরু করে নির্বাচন কেন্দ্রে এজেন্ট হয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার দাবীতে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান যা বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। ডাক দেন অসহযোগ আন্দোলনের। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে যে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল তাতে ছেলেদের পাশাপাশি সচেতন ছাত্রীরাও অংশগ্রহণ করেছিল। সেখানে ছাত্রীদের রাইফেল চালানো, শরীর চর্চা, ব্যারিকেড তৈরি ও প্রাথমিক চিকিৎসা শিক্ষা দেয়া হয়। কাঠের বন্দুক হাতে নিয়ে বহু ছাত্রী অস্ত্র প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন তখন। ভারতের কলকাতায় মহিলা মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অনেকেই ওখানে গিয়ে গেরিলা ট্রনিং গ্রহণ করেন। ট্রেনিং ক্যাম্পটি গোবরা ক্যাম্প হিসেবে পরিচিত ছিল। নারী নেত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ওই ক্যাম্পটি পরিচালনা করতেন। ক্যাম্পে মোট ৪০০ নারী মুক্তিযোদ্ধা ছিল। ভারতের একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার তাঁদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতেন। অনেকেই আবার জনমত তৈরির জন্য ভারতের বিভিন্ন শহর নগর ঘুরে সভা সমাবেশ করেন। ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। সে সময় পল্টন ময়দানে ১০ প্লাটুন ‘জয় বাংলা বাহিনী’র এক প্লাটুন ছাত্রী ছিল। শুধু ঢাকাতেই নয়, বিভাগীয় শহর গুলোতেও নারীরা সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।
বীরকন্যা প্রীতিলতার পথ ধরে চট্টগ্রামের নারী সমাজ মহান মুক্তিযুদ্ধে গৌরবান্বিত ভূমিকা পালন করেন। ৯ মার্চ চট্টগ্রামের জেএমসেন হলে মহিলা আওয়ামী লীগের সভা হয়। এতে বক্তব্য দেন মেহেরুন্নেসা, বেগম শরাফত উল্লাহ, বেগম নাজনীন, বেগম কামরুন্নাহার, বেগম মুছা খান, কুন্দপ্রভা সেন প্রমুখ। ১১ মার্চ চট্টগ্রামে পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে নগরীতে বিরাট মিছিল বের হয়। মিছিলের একমাত্র স্লোগান –
মা বোনেরা প্রীতিলতার পথ ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।
মা বোনেরা ঘর ছাড়ো, প্রীতিলতার পথ ধরো।
কুষ্টিয়ার নাজিয়া ওসমান চৌধুরী রণাঙ্গনে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধে স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণকারী নারীদের মধ্যে আছে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। তবে সবচেয়ে বেশি অংশগ্রহণ করেন গৃহিনীরা। বিভিন্ন স্থানে গেরিলাযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা হাজির হলে তাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। আহতদের সেবা করে সুস্থ করে তুলতেন। গ্রামাঞ্চলে অনেক নারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থান- সংকেত সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেছেন অসীম সাহসে। নিজের জীবনের ঝুঁকি পরোয়া না করে এসব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। নানা বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন, সম্ভ্রম হারিয়েছেন, গ্লানিবোধে জর্জরিত হয়েছেন, সব পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন সাহসিকতার সাথে। কেউ অস্ত্র হাতে সরাসরি, কেউ নার্স, কেউ চিকিৎসক হিসেবেও কাজ করেছেন।
কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নেত্রীরা সারা দেশে তৎপর ছিলেন। তাঁরা বিপুল সংখ্যক নারী পুরুষকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করেছেন। ১৯৭১ সালের ১৮ মার্চ চট্টগ্রামের জেএমসেন হলে উমরতুল ফজলের সভাপতিত্বে মহিলা পরিষদ ও মহিলা আওয়ামী লীগের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রধান অতিথি সুফিয়া কামাল এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন মালেকা বেগম। সভায় তাঁরা স্বাধীনতা আন্দোলনে, দেশরক্ষার সংগ্রামে নারীদের ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। স্বাধীনতা যুদ্ধে চট্টগ্রামের নারীদের গৌরবোজ্জল অংশগ্রহণ চট্টগ্রামের মানুষকে সম্মানিত করেছে।
মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম থেকে যাঁরা বিভিন্ন পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম বেগম মুশতারী শফী। তিনি আগরতলা শরণার্থী ক্যাম্পে শরণার্থীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগাতে কাজ করেছেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা তাঁর মুক্তিযোদ্ধা স্বামী ডা. শফী ও ছোট ভাই এহসানুল হক আনসারীকে অস্ত্রসহ তুলে নিয়ে যাবার পর তিনি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা চলে যান। ডাক্তার নুরুন্নাহার জহুর চট্টগ্রামে মহিলা মুক্তিযোদ্ধা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। চট্টগ্রাম থেকে আরও যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তাঁরা হলেন রমা চৌধুরী, সীমা চক্রবর্তী, প্রান্তিকা চক্রবর্তী, ডাক্তার রেণুকণা বড়ুয়া, ডাক্তার শামসুন্নাহার কামাল যিনি বন্দর হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কমর্রত থাকা অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সহায়তা দিয়েছিলেন, সালেহা চৌধুরী যিনি অসীম সাহস ও বীরত্বের সাথে মহিলা পরিষদের বিভিন্ন মিছিল মিটিং এ নেতৃত্ব দান করেছেন, শ্রীমতি তরুণ মন্ডল এবং আরও অনেক সাহসী মুক্তিযোদ্ধা।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসীর মনোবলকে উদ্দীপ্ত করতে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছিল। যুদ্ধের সময়ে প্রতিদিন মানুষ অধীর আগ্রহে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনার জন্য অপেক্ষা করত। ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানটি এ বেতার কেন্দ্রের সূচনা সঙ্গীত হিসাবে প্রচারিত হতো। মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত রাখার জন্য যুদ্ধশিবিরে গান গেয়ে বেড়িয়েছেন অনেক নারীশিল্পী। যে সব নারী শব্দসৈনিক স্বাধীনতার পক্ষে গান গেয়ে বিশেষ ভূমিকা রাখেন তাঁরা হলেন বেতার ও টিভি শিল্পী অনিতা ঘোষ, শাহীন সামাদ, কল্যানী ঘোষ, সানজিদা খাতুন, শাহনাজ রহমত উল্লাহ, ডালিয়া নওশিন, অমিতা বসু, শিলা ভদ্র, উমা খান, মালা খান, বুলবুল মহলানবীশসহ আরও অনেক গুণী নারীশিল্পী। তাঁদের কন্ঠে ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’-এরকম অসংখ্য কালজয়ী গান মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেরণা দিয়েছে, উদ্বুদ্ধ করেছে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সমগ্র জাতি যখন গভীর সংকটের মোকাবেলা করেন। তখন নারীরা দুর্ভোগের শিকার হয় সবচেয়ে বেশি। সেই অগ্নিগর্ভ সময়ে বিভিন্ন এলাকায় কিশোরী থেকে প্রৌঢ়া নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন, অনেকে শহীদও হয়েছেন। সেলিনা পারভীন, মেহেরুন্নেসা, ভাগীরথী সহ অসংখ্য নারী দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন।
৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত আর ২ লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের এই প্রিয় বাংলাদেশ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার নারী মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির পাশাপাশি ৬৭৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বিভিন্ন খেতাব দিয়েছেন। তার মধ্যে দুজন বীর প্রতীকও আছেন। তাঁরা হলেন মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি ও ক্যাপ্টেন সিতারা। তারামন বিবি একাধিকবার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শত্রদের পরাস্ত করেন। মুক্তিযুদ্ধে ২০টির বেশি সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরজাহান বেগম ওরফে কাঁকন বিবি। তিনি ছদ্মবেশে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের যোগান দেয়া থেকে শুরু করে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
লেখক: প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি,
বোয়ালখালী হাজী মো. নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ।