মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অন্তরে ধারণ করতে হবে

দিলরুবা আক্তার চৌধুরী | শুক্রবার , ১৬ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৫:৪৫ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ উদযাপন করতে যাচ্ছে বিজয়ের ৫১ বৎসর পূর্তি।১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সকল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর সুদৃঢ় নেতৃত্বের ফসল আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের গৌরবগাথা আমাদের বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সোনার বাংলা গড়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে দেশ অদম্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। পাকিস্তানী হানাদাররা বাংলাদেশকে শ্মশান বানিয়েছে, তাইতো মুক্তিযুদ্বের প্রাক্কালে পোস্টারের ভাষা ছিল ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার প্রথম বর্ষপূর্তিতে বলেছিলেন ‘শ্মশান বাংলাকে আমরা সোনার বাংলা গড়ে তুলতে চাই’। আর বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে সোনার বাংলার বাস্তবায়ন বহু আগেই হতো এতে দ্বিমত প্রকাশ করার কোনো অবকাশ নেই।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তথ্য বিবরণীতে বলা হয় ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বরের পূর্বে পূর্ব পাকিস্তানের মোট ব্যাংকে জমা ছিল ৩৬২ কোটি টাকা। পাকিস্তানী বাহিনী নিশ্চিত পরাজয় জেনে ১৫ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ১০০ টাকার নোট পুড়িয়ে দেয়। বাকী টাকার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এছাড়া বাঙালিদের জমাকৃত টাকার ৭০% অবাঙালি মালিকানাধীন ব্যাংকে গচ্ছিত ছিল, যার পরিমান ১৫০ কোটি টাকা যা বাংলাদেশ সরকার আমানতকারীদের দিতে বাধ্য ছিল না।

বাংলাদেশ সরকারের জরিপে দেখা যায় শুধু মুক্তিযুদ্ধকালে ব্যাংক ব্যালেন্স, নগদ অর্থ ও কলকারখানার মূল্যবান সামগ্রী যা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করা হয় তার মূল্যমান ছিল ৭৮৫ কোটি টাকা। বঙ্গবন্ধু আমাদের একটা স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য আজও পাকিস্তানীদের প্রেতাত্মা ব্যাংক লুটেরারা জনগণের অর্থ পাচার করে বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ছে। অথচ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ১৯৭১ সালে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বীর বাঙালি ৯ মাস লড়াই করে পাক হানাদারদের কাছ থেকে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। ধনী-গরীবের কোনো ভেদাভেদ ছিল না। বাঙালি ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করেছে দেশ রক্ষার জন্য। মাঠে ময়দানে রণাঙ্গনে গৃহস্থ বাড়ির বউরা মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ করেছে, বিপদের ঝুঁকি নিয়ে তাঁদের আশ্রয় দিয়েছে। যে যেভাবে পেরেছে ব্যক্তি স্বার্থ তুচ্ছ করেছে দেশ স্বাধীন করার জন্য।

৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ও ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা। কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের কুকর্মের কারণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ম্লান হচ্ছে। করোনা মহামারীর যখন দেশে বিস্তার ঘটেছে, তখন অনেক সুযোগ সন্ধানী অমানুষ লাভের আশায় চাল, তেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী মজুদ করেছে। আর এদিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভর্তুকি দিয়ে, ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করে মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। আবার এক শ্রেণির নরপশু গরীবের ত্রাণ লুট করেছে।

বর্তমানে আবার একই চিত্র, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের জেরে সারা পৃথিবীতে যখন তেলের মূল্য বৃদ্ধি করলো সাথে সাথে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট অন্যান্য সব জিনিসের দাম বৃদ্ধি করে জন জীবন দুর্বিষহ করে তুললো। কালোবাজারীরা প্রয়োজনীয় সামগ্রী মজুদ করে কৃত্রিম ক্রাইসিস তৈরি করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে গরীব মধ্যবিত্ত মারার ব্যবস্থা করলো। এদিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রায় বক্তৃতায় মানুষকে সতর্ক করতে লাগলেন সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা করার জন্য বাড়ির আশেপাশের খালি জায়গায় ফসল ফলানোর তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন, কোনো জমি যাতে অনাবাদী না থাকে সে বিষয়ে সতর্ক করছেন। দুর্নীতি প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে, ‘দুর্নীতি সমাজের ক্যান্সারের মতো। একবার সমাজে এই রোগ ঢুকলে এর থেকে মুক্তি পাওয়া কষ্টকর। আমাদের দেশের বিচারে একটা লোক আরেকটা লোককে হত্যা করলে বিচারে তার ফাঁসি দেয়া হয়। ডাকাতি বা চুরি করলে তাকে কয়েক বৎসর ধরে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু চোরাকারবারিকে ফাঁসি দেওয়া হয় না। ফাঁসি যদি দিতেই হয় তবে চোরাকারবারি এবং দুর্নীতি পরায়ন লোকদেরও দেওয়া উচিত।

বঙ্গবন্ধুর সাথে দ্বিমত প্রকাশ করার কোনো অবকাশ নেই। অবশ্যই এসব মানবরূপী দানবদের কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত যাতে অন্যরা এমন অপকর্ম করতে বিরত থাকে। বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্রের শিকার। একাত্তরে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি তারা এবং তাদের দোসর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা সুযোগ পেলেই বিষধর সাপের ন্যায় ছোবল মারার চেষ্টা করছে। আমরা জানি কিউবার সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনের অপরাধে এবং জোট নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি গ্রহণের কারণে বাংলাদেশকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আমেরিকা সময়মতো গমের জাহাজ পাঠায়নি বাংলাদেশে।

১৯৭৪ সালে এই গম বাংলাদেশের ১০ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচাতে পারতো, এই আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কথা সকলের জানা আছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্রের কারণে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে। আর বাঙালি জাতি হারিয়েছে একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক নেতাকে। ১৯৭৩ সালে বিশ্ব ব্যাংকের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট পিটার কারগিল এক বৈঠকে বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন দাতাদের কাছ থেকে সহায়তা না নিলে বাংলাদেশের জনগণ কী খাবে? বঙ্গবন্ধু তখন বাড়ির জানালার বাহিরে দেখিয়ে কারগিলকে বলেন কী দেখেন? কারগিল বলেছিলেন, সবুজ ঘাস দেখি। আর আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘যদি আপনারা কোনো ধরনের সহায়তা না দেন তবে আমার জনগণ ঘাস খাবে’। এমন আত্নমর্যাদাশীল খাঁটি দেশপ্রেমিক জনদরদী নেতা ইতিহাসে বিরল।

আজ সময়ের দাবি দেশ থেকে মাদক পাচার, অর্থপাচার, চোরাচালান, কালোবাজারি, ঘুষ, দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশপ্রেম অন্তরে ধারণ করতে হবে তবেই আমরা সোনার বাংলা গড়তে পারবো, ২০৩০ এর মধ্যে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, রূপকল্প ২০৪১, ২০৭১ ও ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে পারবো।

লেখক: প্রাবন্ধিক; উপাধ্যক্ষ, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিজয়ের দেশ বাংলাদেশ
পরবর্তী নিবন্ধগৌরবদীপ্ত অনন্য এক দিন