কিছু কিছু বিষয়, চর্চা, অভ্যাস,আচরণ নিজের ভেতরের নিঝুম সত্তাটাকে ভয়ঙ্করভাবে নাড়িয়ে দেয়। এমন কড়া ঘুটুনি দেয় না, পুরো অস্তিত্ব দুমড়ে-মুচড়ে পা উপরে আর মগজ গলে নেমে আছে নিচে! শুনতে অদ্ভুত শোনালেও এটাই সত্যি। যারা এখনো বিবেকের ক্ষীণ ধ্বনি শুনতে পান, নিশ্চয়ই মানবেন, চরম এক অস্থির সময় পার করছি আমরা। যাদের সুযোগ আছে, তারা সামনে যা কিছু পাই, সব হাতিয়ে আচ্ছাসে সত্যের ফেনা, নীতি-নৈতিকতার ঢোল বাজাই-গীত গাই। টিভি টকশো, সভা, সেমিনার, আলোচনা সবখানেই। ছাপা শব্দ বা সাইবার দিগন্তের সব অলি-গলিতেও।
নিজেকে একটু যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে দেখি, আস্ত ভন্ড আমি। মানুষ হয়ে বাঁচতে হলে সবার আগে চাই, সত্য-সত্য এবং সত্য। কারণ সত্য ছাড়া ধর্ম নাই, কর্ম নাই, বিবেক নাই, নীতি-নৈতিকতা নাই। সত্য, জীবন থেকে ছেটে ফেললে কেউ আর মানুষ থাকে না, রঙিন ছাল-বাকলে মোড়া দ্বিপদী ভক্ষক বা রাক্ষস-খোক্কসে রূপান্তরির হয়। তন্নতন্ন করে খুঁজে নিজের অস্তিত্বে কিছু সত্যের আলো পেয়েছি। হোক না, জোনাক পোকার মত অতি সামান্যই। তবুওতো আলো। কিন্তু এই আলোটাই সর্বনাশ ডেকে এনেছে। এটা চর্চা করতে গেলেই বিপদ! তাড়িয়ে বেড়ায় ভয়ঙ্করভাবে ঘরে বাইরে সবখানে। সত্যকে গিলে নিয়ে মিথ্যার দানবটা এত বেশি ক্ষমতাধর, সে নিজেই এখন সত্যের ধারক! সত্য বিলকুল মিথ্যা, আর মিথ্যা হয়ে গেছে সত্য! কী এক অসহ্য যন্ত্রণা! মানুন বা নাই মানুন, নিজে একদম একঘরে জীব। এক চিলতে সত্য ধারণে এত শাস্তি, তাহলে পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থায় যারা সত্যের রজ্জু ধারণ করে আছেন, তারা কেমন আছেন- কোথায় আছেন? ধারেকাছে থাকলে এগিয়ে আসুন, বাঁচান প্লিজ।
না, কেউ কোথাও নেই। অন্তত আমাদের প্রিয় দেশটিতে নেই হয়ে গেছে। অথবা নিজে সামান্যই ধারণ করি বলে সত্যের আলো লুকিয়ে আছে মিথ্যার ভুঁড়িতে। আরও একটি বড় ব্যাখ্যা আছে। হয়তো, পুরো অসৎ বা অসত্যের ডোবায় নাক ডুবানোর সুযোগ হয়নি বলেই নিজে সত্যের অণু ধারণ করে আছি। না হলে কবেই ছেড়ে-ছুড়ে দানবের সাথে শেকহ্যান্ড করে লোভ-ভোগের পেয়ালায় নাক ডুবিয়ে ধর্ম-কর্মসহ ভূয়া ও চটকদার সত্য দানবের সেবায় ডুগডুগি বাজাতাম প্রতিদিন। এটাই সত্য মানি, সুযোগ পাইনি, তাই কিছুটা সুস্থ আছি। আঁকড়ে আছি সত্যের এক চিমটি জমি। সুযোগ অবশ্য বেশকিছু এসেছে, লেজের চাবুক চালিয়ে ভেগেও গেছে। অনেকে জিরো থেকে এখন হিরো। নামী দামি ক্ষমতাবান। বিশাল বিত্ত বৈভবও। ওনাদের বিত্ত বৈভবের মহাসড়কে তুলে দিয়ে নিজে সটকে পড়েছি মানে মানে। কারণ পুঁটির কী বোয়াল গিলার সাধ্য আছে? নাই। মিথ বা অজানা কিছু না, নগরের বহুজনে জানে। নিজে বলি না, বলাবলি বা বড়াই করা মানেই ক্ষুদে জনের বিড়ম্বনা।
আসল সত্য হচ্ছে, আমাদের ধারেকাছে, চর্চায় সত্যই নাই। ঘরে-ঘরে অসত্য দানবকে সেবা দিয়ে আমরা নানা মিডিয়া, রাজনৈতিক ময়দান, মঞ্চ, মসজিদ, মাদ্রাসা, মঠ, মন্দির গির্জায় টানা সত্যের ফেনা স্প্রে করছি। স্প্রে করার পরপরই মুছে যায়। ফেনার ধর্মই হচ্ছে, একটু রঙ ছড়িয়ে মুছে যাওয়া দ্রুত। দেশে বুদ্ধিজীবি, জ্ঞানী, বিদ্যান, ধর্মবেত্তা, আলেম ওলামা প্রচুর। ববিউল আউয়াল মাসে আলেম-ওলামার কান্নায় রাতভর মাইকের বহু স্পিকার টানা নির্ঘুম শব্দ হুঙ্কার উদগীরণ করে যায়। কিন্তু ভোরেই সব ফেনা হয়ে গায়ের! মাঝখানে রাতভর কষ্ট পায় আশপাশের শিশু, বয়স্ক ও রোগী। কেন এমন হচ্ছে, ভাবার কেউ নেই। এত ভাবাভাবি করলে নিজের ভাগ এবং পাতে টান পড়বে তো! আর বাড়াচ্ছি না।
শেষ এবং একমাত্র নিদান একটাই, ঘরে-ঘরে অসত্যের দানব হঠিয়ে সত্যের আবাদ চাই। প্রতিটি পরিবারে যদি সত্যের বাতি জ্বলে, দেশে অস্থিরতা, হানাহানি, মারামারি, ধর্মীয় বিদ্বেষ, সামপ্রদায়িক আগুন, বৈষম্য, ঘুষ, লুট, দুর্নীতি, অনিয়ম কিছুই থাকবে না। কারণ শব্দগুলোর সাথে সত্যের বিরোধ ভয়ঙ্কর। এমন হলে কোন সংস্কার ছাড়াই দেশে আলো ও সুন্দরের সুবাসিত কুসুম ফুটবেই।