মা স্নেহ বিলিয়ে দেন, শাশুড়ীমা স্নেহ জমিয়ে রাখেন

শিউলী নাথ | সোমবার , ৮ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৯:৪১ পূর্বাহ্ণ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে বলেছেন ‘প্রবল প্রতাপশালীর ক্ষমতা, মদমত্ততা, আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় তারই প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে ’। পশ্চিমাদের দম্ভের দিকে তাকিয়েই একদিন কবিগুরু এই উক্তিটি করেছিলেন। কিন্তু সেই উক্তি আজ সভ্যতা ছাড়িয়ে রাষ্ট্র, সমাজ তথা পরিবারের মাঝেও চিরন্তন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আজ এত কঠিন উদাহরণ না দিলেও বোধ হয় চলতো। কেননা যে চরিত্রটি নিয়ে কথা বলার তীব্র ইচ্ছা ব্যক্ত হয়েছে সেই চরিত্রটি কঠিন কিন্তু শাশ্বত। সময়ের স্রোতে সেই চরিত্রটি আজ খেই হারাতে বসেছে। অথচ একটা সময়ে তার জীবনেও একটা দোর্দণ্ড প্রতাপ ছিল। আদরে, সোহাগে, শাসনে, মায়ার বন্ধনে সংসারের সবাইকে আগলে রাখার দায়িত্ব একাই কাঁধে তুলে নিতেন। এসব দায়িত্ব পালন করতে করতে তিনি বিভিন্ন জনের দৃষ্টিতে বিভিন্নভাবে রূপায়িত হতেন। সংসারে ছেলেমেয়েদের কাছে স্নেহময়ী জননী কখনো বা কড়া শাসনের মা, গৃহকর্তার কাছে পরিশ্রমী, ন্যায় ও শাসন দণ্ডের আঁধার। গৃহবধূদের কাছে রাগী অথচ সোহাগ অন্তপ্রাণ এক শাশুড়ি। মেয়ে জামাইদের কাছে শান্ত ও লজ্জাবতী শাশুড়ি। আর নাতি নাতিনদের কাছে? সেতো হিন্দি মুভি “12th Fail” এর দাদীকে স্মরণ করিয়ে দেয়। যেখানে স্নেহ ভালোবাসার এক গুপ্তখনি। যত দুষ্টুমি করুক না কেন সব ধরনের ক্ষমার জাল বেষ্টনীতে উত্তরাধিকারীদের জড়িয়ে রাখেন তিনি। ঋতুপরিক্রমার সাথে সময়োপযোগী পিঠা পার্বন সহ সকল খাদ্যের তালিকা তার চিন্তার সাথে যুক্ত ছিল। এই হলেন আমাদের আজকের চরিত্র। ‘শাশুড়ি মা’। প্রতিটি সংসার যাকে ছাড়া অচল। বিয়ের পর অন্য ঘর থেকে একজন মেয়ে এসে শ্বশুরবাড়িতে যখন দিকশূন্য হয়ে পড়ে তখন যে হাতটি সর্বপ্রথম এগিয়ে আসে সেটি হল শাশুড়ি মায়ের। বয়সের প্রতাপে হয়তো অনেকেই রাগী চেহারা দেখেছেন, শাশুড়ি সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন। একই সাথে থাকলে ভালোমন্দ চিন্তা চেতনায় দ্বিমত থাকতেই পারে। কিন্তু তিনিও মা। তিনি অন্তরে ভালোবাসা জমিয়ে রাখেন এবং সংসারী হবার সকল পথ দেখিয়ে দেন। নিজের খাবারটা অনেক সময় সস্নেহে পুত্রবধূদের পাতে তুলে দেন। কিন্তু বাইরে রাগী ভাব বজায় রাখেন। মাঝে মাঝে মনে হয় সে সময়ের শাশুড়িরা বোধ হয় তাদের শাশুড়িদের থেকে অতটা মাতৃসুলভ ভালোবাসা পাননি।

বয়সের ভারে ন্যূব্জ আজ সামনে যিনি বসে আছেন খুব ইচ্ছে করে বড় মাছের টুকরো বা মুড়োটা পাতে দিয়ে বলি ‘মা পুরোটা খেয়ে নেবেন’। বাটি ভর্তি করে ফলগুলো টুকরো করে কেটে সামনে দিয়ে বলি ‘সবগুলোই খাবেন মা’। কিন্তু বয়সের কাছে হার মানা দাঁতগুলো সেই কবেই ঝরে গেছে। তবুও স্মিত মুখে একফালি হাসির রেখায় আমাদের ভরিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। ভাবি এটাই জীবনের আবর্ত। একদিন ভরা সংসার শাসন করার মানুষটাকে কত নমনীয় হয়ে যেতে হয় কিংবা অন্যের উপর নির্ভরশীল হতে হয়। দম্ভ, প্রভাবশালী আচরণ মুহূর্তেই শিশুসুলভ মনোভাবে পরিণত হয়ে যায়। আমরা আজকের প্রেক্ষাপটে যতই প্রতাপশালী বা ক্ষমতাবান হই না কেন বিধাতা মানুষকে কোথায় যেন অসম্পূর্ণ করেই রেখেছেন। তাই সবাইকে নির্দিষ্ট ওই দিনের অপেক্ষায় থাকতে হবে। তবে সুস্থ নিরোগ ও ভালো থাকার কর্মগুলো আমাদের করে যেতে হবে। পৃথিবীর সকল মারূপী শাশুড়িগণ যেন শেষদিন পর্যন্ত চলাফেরায় সক্ষম থাকতে পারেন এই প্রার্থনাটুকু করি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচিঠি
পরবর্তী নিবন্ধস্মার্ট স্কুলবাস ও নিরাপদ শিক্ষাজীবন