দশ বছরের শিশু আবদুল্লাহ, পেটের তাগিদে বেছে নেয় ট্রেনে পানি বিক্রির কাজ। ট্রেনে পানি বিক্রি করতে করতে একদিন গাজীপুর থেকে চট্টগ্রামে চলে আসে সে। অচেনা চট্টগ্রামে এসে ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছে যায় হাটহাজারীতে।
তার বাবা একটি ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকের কাজ করেন। মা কাজ করেন মানুষের বাসা-বাড়িতে। অনটনের সংসারে পেটের দায়ে শিশুটিও নেমে পড়েছিল জীবন-যুদ্ধে। ভবঘুরের মতো ঘুরতে থাকা আব্দুল্লাকে এক পর্যায়ে হাটহাজারী থানা পুলিশ উদ্ধার করে। গত ২৮ নভেম্বর শিশুটিকে চট্টগ্রামের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। আদালতের নির্দেশে নগরের রৌফাবাদ মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতিষ্ঠানে ঠাঁই হয় তার। যেখানে থাকা ১০২ জন মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুর সাথে কোনোভাবেই সাচ্ছন্দ্যবোধ করছিল না আব্দুল্লাহ। সেখানকার মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুরা তাকে মারধর করে ও তার শরীরের কাপড় ছিড়ে ফেলে।
এক পর্যায়ে আব্দুল্লাহ’র বিষয়টি প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ আবুল কাশেমের নজরে আসে। আচার-আচরণ দেখে তিনি বুঝতে পারেন শিশুটি মানসিক প্রতিবন্ধী নয়। পরে আব্দুল্লাহকে হাউস প্যারেন্ট আম্বিয়া বেগমের বাসায় রাখা হয়। হাউস প্যারেন্ট আম্বিয়াসহ অন্যান্যরা আলাদা করে শিশুটিকে কাউন্সিলিং শুরু করেন। পরবর্তীতে আব্দুল্লাহ’র বিষয়টি বিভাগীয় সমাজ সেবা কার্যালয়ের পরিচালক কাজী নাজিমুল ইসলামকে অবহিত করেন অধ্যক্ষ আবুল কাশেম। বিভাগীয় পরিচালকের পরামর্শে শিশুটিকে খুলশীস্থ বিভাগীয় সমাজ সেবা কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। সেখানেই নাম-ঠিকানা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় শিশুটির কাছে। এক পর্যায়ে গাজীপুর থেকে হারানোর বিষয়টি নিশ্চিত হন সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। নিশ্চিত হওয়ার পর শিশুটির বাবা-মায়ের খোঁজ শুরু করেন। সমাজকর্মী সুমন আলীর মাধ্যমে গাজীপুরের সমাজসেবা সংশ্লিষ্টদের সাথে যোগাযোগ করে আব্দুল্লাহর ছবি পাঠানো হয়। এক পর্যায়ে আবদুল্লাহর বাবা মো. সালাউদ্দিনের খোঁজ পাওয়া যায়। পরে গাজীপুর থেকে চট্টগ্রামে ছুটে আসেন মো. সালাউদ্দিন।
চট্টগ্রামের বিভাগীয় সমাজ সেবা কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে গত বৃহস্পতিবার পিতাপুত্র দুজনকেই চট্টগ্রামের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। যাবতীয় বিষয় যাচাই-বাছাই করে আব্দুল্লাহকে তার বাবার কোলে হস্তান্তরে নির্দেশনা দেন আদালত। আদালতের নির্দেশনা অনুসারে বৃহস্পতিবারই চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমাজ সেবা কার্যালয়ের পরিচালক কাজী নাজিমুল ইসলাম শিশুটিকে তার বাবার কাছে হস্তান্তর করেন। খুলশীস্থ বিভাগীয় সমাজ সেবা কার্যালয়ে এ সময় অতিরিক্ত বিভাগীয় পরিচালক মোস্তাকুর রহিম, সহকারী পরিচালক মো. শাহী নেওয়াজ, মানসিক প্রতিবন্ধী প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও উপ-পরিচালক আবুল কাশেম, সমাজকর্মী সুমন আলী, ইউনিসেফের কনসালটেন্ট সফিকুল ইসলামসহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন। ছেলেকে ফিরে পেয়ে আনন্দশ্রু বয়ে পড়ছিল বাবা মো. সালাউদ্দিনের চোখে।
কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলছিলেন, ছেলের খোঁজ পেলেও তাকে চট্টগ্রামে এসে নিয়ে যাওয়ার মতো সামর্থ্য আমার ছিল না। সমাজসেবা অফিসের স্যারদের আন্তরিক সহযোগিতার কারণেই ছেলেকে ফিরে পেয়েছি। যাতায়াতের গাড়ি ভাড়াও উনারা দিয়েছেন। উনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার নেই। আল্লাহ উনাদের মঙ্গল করুক।
হারিয়ে যাওয়া শিশু আবদুল্লাহকে তার বাবার কোলে ফিরিয়ে দিতে পেরে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন বিভাগীয় সমাজ সেবা কার্যালয়ের পরিচালক কাজী নাজিমুল ইসলাম। তিনি বলেন, হারিয়ে যাওয়া শিশুটি তার মা-বাবার কোল ফিরে পেয়েছে দেখে আমাদেরও ভালো লাগছে। এক্ষেত্রে আমাদের সহকর্মীদের আন্তরিকতার কমতি ছিল না। শেষ পর্যন্ত তাদের প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। এজন্য সহকর্মী ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান বিভাগীয় সমাজ সেবা কার্যালয়ের পরিচালক কাজী নাজিমুল ইসলাম।